
ছবি: সংগৃহীত
গাজা উপত্যকায় নয় দিন ধরে কার্যকর থাকা নাজুক যুদ্ধবিরতি রবিবার আবারও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, হামাস যোদ্ধারা তাদের বাহিনীর ওপর হামলা চালানোর পর তারা ‘প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালিয়েছে। এই অভিযোগের পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে, যা পুরো যুদ্ধবিরতিকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে হামাস তাদের পক্ষ থেকে যে কোনো ধরনের হামলার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। তারা জানায়, তারা এখনো যুদ্ধবিরতি পুরোপুরি মেনে চলছে এবং ইসরায়েলই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য’ নতুন সংঘর্ষ উসকে দিচ্ছে। হামাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ইসরায়েল আবার যুদ্ধ শুরু করার জন্য অজুহাত খুঁজছে। তারা মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে, যাতে নিজেদের আক্রমণকে বৈধতা দেওয়া যায়।”
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে হামাসকে ‘যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনকারী সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, “হামাসের এই আক্রমণ যুদ্ধবিরতির মৌলিক শর্ত ভঙ্গ করেছে, যা ইসরায়েল কখনোই মেনে নেবে না।” এর পরপরই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দেন, “গাজার সন্ত্রাসী অবকাঠামো ও হামাস-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কঠোর সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।”
এই যুদ্ধবিরতি চুক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর কার্যকর হয়েছিল। চুক্তির আওতায় উভয় পক্ষ অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয় এবং একে অপরের হাতে বন্দী ও জিম্মিদের বিনিময়ে সম্মত হয়েছিল। একই সঙ্গে গাজার পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে একটি উচ্চাভিলাষী ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও আলোচনায় আসে। আন্তর্জাতিক মহল একে মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তির দিকে একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ মোড়’ হিসেবে দেখেছিল।
তবে মাত্র নয় দিন পেরোতেই সেই শান্তি আবারও ভঙ্গের মুখে। ইসরায়েল দাবি করছে, হামাস যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে রাফা সীমান্ত এলাকায় তাদের সেনাবাহিনীর ওপর অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে এবং গুলি চালিয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, “চুক্তির শর্ত অনুযায়ী রাফা এলাকায় সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসের কাজে নিয়োজিত আইডিএফ বাহিনীর ওপর হামাসের সন্ত্রাসীরা ক্ষেপণাস্ত্র ও গুলি চালায়। এরপর আমাদের বাহিনী বিমান ও গোলন্দাজ হামলার মাধ্যমে পাল্টা জবাব দেয়।”
ফিলিস্তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি জানায়, রাফা শহরের দক্ষিণাঞ্চলে সকাল থেকেই ভারী সংঘর্ষের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয়রা জানায়, ইসরায়েলি ড্রোন এবং যুদ্ধবিমান এলাকাটির ওপর টহল দিচ্ছিল, এরপরই দুটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩৮ বছর বয়সী এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম হামাসের যোদ্ধারা আবু শাবাব নামের একটি স্থানীয় ফিলিস্তিনি দলের সঙ্গে লড়ছে। কিন্তু হঠাৎ আমরা দেখতে পাই, এলাকাটিতে ইসরায়েলি সেনা ট্যাঙ্ক প্রবেশ করছে। কিছুক্ষণ পরই আকাশ থেকে দুটি বিমান হামলা হয়।”
এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আবারও দাবি করেন, “হামাস ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের সেনাদের টার্গেট করছে। আমরা ধৈর্যের সীমায় পৌঁছে গেছি। যুদ্ধবিরতি মানা হচ্ছে না।”
এই সংঘর্ষের সময়ই প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে নিরাপত্তা বৈঠক করছিলেন। বৈঠকে যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ ও বন্দী বিনিময় প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বৈঠক শেষে কয়েকজন কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেন, “হামাসকে আর কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। এখন সময় এসেছে পূর্ণ শক্তিতে গাজায় অভিযান চালানোর।”
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্ট বলেন, “যদি হামাস আমাদের ওপর একবারও হামলা চালায়, আমরা তা শূন্য সহনশীলতায় মোকাবিলা করব। যুদ্ধবিরতি কখনো একতরফা হতে পারে না।”
জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়েই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড বলেন, “যুদ্ধবিরতি রক্ষা করা না গেলে গাজা আবারও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। আমরা উভয় পক্ষকেই সংযম দেখানোর আহ্বান জানাই।”
হোয়াইট হাউস থেকেও এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে সব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। বিবৃতিতে বলা হয়, “এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এখনই উভয় পক্ষকে আত্মসংযম দেখাতে হবে।”
গাজার স্থানীয় প্রশাসন বলছে, যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। তবে নতুন করে সংঘর্ষের খবরে স্থানীয় জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে গাজা শহর ছাড়ছে। হাসপাতালগুলোও আবার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নতুন আহতদের চিকিৎসার জন্য।
একজন স্থানীয় শিক্ষক বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম অবশেষে শান্তি ফিরছে। কিন্তু এখন আবার সেই ভয় ফিরে এসেছে। শিশুরা রাতে ঘুমাতে পারছে না, কারণ তারা জানে না, কখন আবার বোমা পড়বে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই যুদ্ধবিরতির ভাঙন শুধুমাত্র গাজা নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইউসুফ আল-হাদ্দাদ বলেন, “যদি ইসরায়েল ও হামাস আবার পূর্ণাঙ্গ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে এটি ২০২১ সালের যুদ্ধের চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। উভয় পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস এতটাই গভীর যে, সামান্য উসকানিও বড় আকারের যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে।”
বর্তমানে গাজা সীমান্তে সেনা সমাবেশ জোরদার করা হয়েছে এবং ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গাজার আকাশে টহল অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে হামাসের রাজনৈতিক শাখা জানাচ্ছে, তারা কূটনৈতিকভাবে যুদ্ধবিরতি রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে আত্মরক্ষার অধিকার তারা কখনো হারাবে না।
সব মিলিয়ে, গাজার এই নাজুক যুদ্ধবিরতি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। উভয় পক্ষের পারস্পরিক অবিশ্বাস, রাজনৈতিক চাপ ও সামরিক প্রতিক্রিয়ার জেরে শান্তির এই প্রচেষ্টা টিকে থাকবে কিনা—সেটাই এখন পুরো বিশ্বের চোখে বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ