
ছবি: সংগৃহীত
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পকে ঘিরে নতুন করে দেখা দিয়েছে নাশকতার আশঙ্কা। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শিল্পমহল থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থা পর্যন্ত উদ্বেগে রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি নির্ভর শিল্পখাত কি এখন পরিকল্পিতভাবে টার্গেট করা হচ্ছে? সরকারের শীর্ষ পর্যায়ও বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখছে। শিল্পাঞ্চলে বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা, গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে, আর নেপথ্যে ‘দেশবিরোধী চক্র’ সক্রিয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গত পাঁচ দিনের ব্যবধানে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, যার সবকটিই সরাসরি বা পরোক্ষভাবে পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রথমটি ঘটে ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে, যেখানে দুটি গার্মেন্ট কারখানায় আগুনে ১৬ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। দুদিন পর ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) একটি পোশাক কারখানায় ভয়াবহ আগুন লাগে। সর্বশেষ শনিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ঘটে বিশাল অগ্নিকাণ্ড, যেখানে কোটি কোটি টাকার আমদানি ও রপ্তানি পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এই তিনটি ঘটনার মধ্যে সময় ব্যবধান এবং লক্ষ্যবস্তু একরকম হওয়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নাশকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, “অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে আমরা বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা হিসেবে দেখছি না। এর পেছনে বড় কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “এখন পর্যন্ত প্রাথমিক তদন্তে বেশ কিছু ‘অস্বাভাবিক মিল’ পাওয়া গেছে। কিছু কারখানায় অগ্নি-নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিকঠাক থাকলেও, আগুনের গতি ও বিস্তারের ধরন সন্দেহজনক।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে সরকারবিরোধী চক্রগুলো নানা উপায়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তখনকার গণ-অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর তারা নতুন কৌশলে পোশাকশিল্পকে টার্গেট করেছে, যা দেশের অর্থনীতির মূলভিত্তি। সূত্রগুলোর ভাষায়, “দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পোশাকশিল্পে আগুন লাগানোর মতো নাশকতা ঘটানো হতে পারে।”
সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের মতো শিল্পাঞ্চলে আগেও গুজব ছড়িয়ে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ানো হয়েছিল। তখন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এখন আবারও একই কৌশলে বিদেশে অবস্থানরত কিছু ব্যক্তি এবং তাদের দেশীয় সহযোগীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
একজন সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “বিদেশে বসে যারা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালায়, তারা এখন গার্মেন্ট খাতকে কেন্দ্র করে নতুন গল্প তৈরির চেষ্টা করছে। বিমানবন্দর, ইপিজেড বা বড় গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে ‘অবিশ্বস্ত সরবরাহকারী’ হিসেবে তুলে ধরতে সহজ হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।”
বাংলাদেশ নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “কার্গো ভিলেজের মতো স্পর্শকাতর স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সত্যিই উদ্বেগজনক। রপ্তানি পণ্য খোলা জায়গায় রাখা হয়, যেখানে নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা নেই। এখন প্রশ্ন উঠছে, এটি কেবল দুর্ঘটনা, নাকি নাশকতা? সরকারের উচিত অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্ত শুরু করা।”
তিনি আরও বলেন, “চট্টগ্রাম ইপিজেডে আগুনের ঘটনার পর এত দ্রুত আরেকটি স্থানে বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটায় আমরা হতবাক। বিদেশি ক্রেতারাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানি অর্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “আমি মনে করি, পোশাকশিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছে। বিমানবন্দর বা ইপিজেডের মতো উচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় আগুন লাগা কখনোই স্বাভাবিক নয়। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত।”
তিনি আরও যোগ করেন, “৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায়নি। এখন সময় এসেছে তারা পূর্ণোদ্যমে মাঠে নেমে শিল্পাঞ্চলে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।”
গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, কিছু অসাধু গার্মেন্টস মালিকও এই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। বিগত সরকারের সময় যারা সুবিধাভোগী ছিলেন, তারাই এখন সরকারবিরোধী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। অতীতে এদের কয়েকজন শ্রমিক আন্দোলন উসকে দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। ৫ আগস্টের পর কিছু মালিক ও শ্রমিক নেতাকে চিহ্নিত করা হয়, যাদের কর্মকাণ্ড এখন গোয়েন্দা পর্যবেক্ষণের আওতায় আছে।
একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “অগ্নিকাণ্ড হওয়া কারখানাগুলোর শ্রমিক, নিরাপত্তাকর্মী, এমনকি ব্যবস্থাপকদের রাজনৈতিক পরিচয়ও যাচাই করা হচ্ছে। কারও সঙ্গে সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন বা যোগাযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. আব্দুল মঈন খান মনে করেন, “বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখন শুধু অর্থনৈতিক খাত নয়, এটি রাজনৈতিক অস্ত্রও বটে। এখানে নাশকতা ঘটলে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমে, এবং বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প বাজার খোঁজে। তাই যারা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায়, তারা স্বাভাবিকভাবেই এই খাতকে টার্গেট করবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর হাসান বলেন, “এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড শুধু দুর্ঘটনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। এখানে ‘প্যাটার্ন’ আছে। লক্ষ্যবস্তু বাছাই, সময় এবং প্রতিক্রিয়া—সব কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এটি সংগঠিত অপরাধ। এখন প্রয়োজন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত অপারেশন এবং ডিজিটাল নজরদারি।”
আরও একজন শ্রমনীতি বিশ্লেষক রেহানার হক বলেন, “এ ধরনের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নেতিবাচক বার্তা পাঠায়। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ফলে তারা অর্ডার কমিয়ে দিতে পারে, যার প্রভাব পড়বে লাখো শ্রমিকের জীবনে।”
সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, বিদেশভিত্তিক কিছু ওয়েবসাইট ও সামাজিক মাধ্যম চ্যানেলে ইতিমধ্যেই গার্মেন্ট খাতে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, “বাংলাদেশে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ ভয়াবহ, অগ্নিনিরাপত্তা নেই, সরকার বিষয়টি গোপন করছে।”
একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “এই প্রচারণা পরিকল্পিতভাবে চালানো হচ্ছে যাতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বাজারে ‘ঝুঁকিপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র’ হিসেবে দেখানো যায়। এভাবেই বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট করার চেষ্টা চলছে।”
বিজিএমইএ’র সিনিয়র সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান রোববার কার্গো ভিলেজ পরিদর্শন শেষে বলেন, “আমরা চাই, ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পাক। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো, এই অগ্নিকাণ্ড নাশকতা না দুর্ঘটনা—তা দ্রুত পরিষ্কার হওয়া। সরকারের উচিত নিরপেক্ষ তদন্তে সত্য উদঘাটন করা।”
তিনি আরও বলেন, “পোশাকশিল্পের সঙ্গে দেশের সুনাম ও অর্থনীতি গভীরভাবে জড়িত। এই খাত অস্থিতিশীল হলে বাংলাদেশ বিপুল ক্ষতির মুখে পড়বে। তাই সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার শিল্পাঞ্চলগুলোতে অতিরিক্ত মোবাইল টহল জোরদার করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা মহড়াও আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি সন্দেহজনক ব্যক্তিদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখতে সিসিটিভি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
গণমাধ্যমে নাশকতা-সংশ্লিষ্ট গুজব ছড়ানো রোধে সাইবার ইউনিটও সক্রিয় হয়েছে। সরকার জানিয়েছে, “যে-ই হোক, দেশের পোশাকশিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।”
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত আজ কেবল অর্থনৈতিক শক্তির প্রতীক নয়, এটি জাতীয় স্থিতিশীলতারও প্রতিচ্ছবি। তাই একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের পেছনে যদি সত্যিই নাশকতা থাকে, তবে তা দেশের অর্থনীতির ওপর সরাসরি আঘাত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই ষড়যন্ত্র দীর্ঘমেয়াদে দেশের রপ্তানি, বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সুনাম—সবকিছুর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কি সময়মতো সেই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে পারবে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ