
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি বেসরকারি খাত। শিল্প-কারখানা, রপ্তানি বাণিজ্য এবং কর্মসংস্থানের মূল ভরসা এই খাত বর্তমানে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা, কারখানায় হামলা-ভাঙচুর, শ্রমিক অসন্তোষ, এমনকি অগ্নিসংযোগের ঘটনায় শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে নতুন বিনিয়োগে, কর্মসংস্থানে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিস্থিতি হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে ওঠে। একদিকে মামলা ও হয়রানিমূলক পদক্ষেপ, অন্যদিকে কারখানা ভাঙচুর ও শ্রমিক আন্দোলনের কারণে দেশের বৃহৎ শিল্পাঞ্চলগুলো—গাজীপুর, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে—অভূতপূর্ব ক্ষতির মুখে পড়ে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসেই প্রায় চার শতাধিক কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন মালিকরা। একজন কারখানা মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার ৩০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে এমন দুঃস্বপ্ন দেখিনি। শ্রমিকদের আন্দোলনের আড়ালে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক আমার কারখানায় ঢুকে ভাঙচুর চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয়। কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হলো, অথচ এর বিচার পাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আমার বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছে।”
শিল্পোদ্যোক্তাদের দাবি, রাজনৈতিক অবস্থান বা পূর্ববর্তী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে অনেক ব্যবসায়ীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। শ্রমিক অসন্তোষের পেছনেও ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করা হচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সফিকুল ইসলাম খান সবুজ বলেন, “অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে কিছু অসাধুচক্র মামলা বাণিজ্যে জড়িয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভয় দেখাতে, হয়রানি করতে এবং অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে এই মামলা ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এঁরা দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন।”
অন্য আইনজীবী নাহিদুল ইসলাম বলেন, “যেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তাঁদের মামলা থেকে বাদ দিতে হবে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা অর্থনীতির জন্য এক মারাত্মক বাঁধা।”
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে বেসরকারি খাতের উন্নতি সম্ভব নয়। বিনিয়োগের জন্য শুধু টাকা থাকলেই হয় না, স্থিতিশীল পরিবেশও লাগে। যত দিন পর্যন্ত অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হবে, তত দিন ব্যবসার পরিবেশও স্বাভাবিক হবে না।”
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, “কোনো বছরের বিনিয়োগ সাধারণত কয়েক বছর ধরে প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। ২০২৫ সালে বিনিয়োগ কমে গেলে এর প্রভাব পড়বে আগামী কয়েক বছর ধরে। কর্মসংস্থানের সংকট বাড়বে, দারিদ্র্যও বাড়তে পারে।”
বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “মিথ্যা মামলায় আমাদের অনেক সদস্যকে জড়ানো হচ্ছে। আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলছি, যাতে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার না হন। কিন্তু এখনো পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি।”
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “বিনিয়োগ হচ্ছে না, ব্যাংকঋণের চাহিদা বাড়ছে না, ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে—২২ বছরের ইতিহাসে যা সর্বনিম্ন। কাঁচামালের আমদানিও কমছে। এর সবই আস্থাহীনতার ইঙ্গিত। নির্বাচিত সরকার ছাড়া ব্যবসায়ীরা আস্থা ফিরে পাবেন না।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির বলেন, “শতাধিক কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি আস্থায় ফিরতে পারেননি। আস্থা পুনরুদ্ধার করা এখন সরকারের প্রধান কাজ।”
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “মামলা-হয়রানির কারণে উদ্যোক্তারা বড় কোনো উদ্যোগ নিতে সাহস পাচ্ছেন না। স্থানীয় উৎপাদকরা কারখানা সম্প্রসারণ স্থগিত রেখেছেন। বেসরকারি খাত ছাড়া প্রবৃদ্ধি হবে না।”
-
বিনিয়োগ স্থবিরতা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির জন্য খোলা এলসি ২৫ শতাংশ কমেছে। নতুন বিনিয়োগ কার্যত স্থবির।
-
ঋণপ্রবৃদ্ধি: বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবৃদ্ধি জুলাই মাসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৫২ শতাংশ, যা দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট নয়।
-
জিডিপি প্রবৃদ্ধি: ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৯৭ শতাংশ, আগের বছর যা ছিল ৪.২২ শতাংশ। একইসঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে, আগের বছর যা ছিল ২৩.৫১ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৬৩ শতাংশে। বর্তমানে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ ৩০ হাজার। বিনিয়োগ না বাড়লে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, যা সামাজিক অস্থিরতা বাড়াবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে। বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা দাবি তুলেছেন—
-
সব ধরনের হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
-
কারখানা ও ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
-
ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন বন্ধ করে দীর্ঘমেয়াদি ও পূর্বানুমেয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
-
সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী সংগঠনের নিয়মিত সংলাপ চালু রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো আস্থা ফিরিয়ে আনা। মামলা-হয়রানি বন্ধ করে ব্যবসায়ীদের একটি নিরাপদ ও হয়রানিমুক্ত পরিবেশ দিলে তারা আবার বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। বেসরকারি খাতের গতি না ফিরলে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান এবং দারিদ্র্য নিরসন—সবই বাধাগ্রস্ত হবে।
ড. মাহফুজ কবিরের ভাষায়, “এই মুহূর্তে অর্থনীতির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আস্থা পুনরুদ্ধার। সরকারকে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। তা হলে বেসরকারি খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং অর্থনীতির চাকায় নতুন গতি আসবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ