ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দযাত্রা এক মুহূর্তে পরিণত হলো মৃত্যুর মিছিলে। পরিবারের সবাই মিলে সমুদ্র দেখতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই সড়কেই নিভে গেল পাঁচটি প্রাণ। কক্সবাজারের চকরিয়ায় যাত্রীবাহী বাস ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে একই পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়েছেন এবং আরও কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনাটি ঘটে বুধবার (৫ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার হাঁসের দিঘী ঢালা এলাকায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সকালবেলা কুমিল্লা থেকে একটি পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসে ৮ জন যাত্রী কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হয়। মাইক্রোবাসটি যখন চকরিয়া পৌরসভার হাঁসের দিঘী ঢালায় পৌঁছায়, তখন বিপরীত দিক থেকে আসা দ্রুতগতির মারসা পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের তীব্রতায় মাইক্রোবাসটি দুমড়ে–মুচড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই পাঁচজন মারা যান।
নিহতদের সবাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার একই পরিবারের সদস্য। তারা হলেন—এনামুল হক পাটোয়ারীর স্ত্রী রুবি বেগম (৩৫), তার মা ও শাশুড়ি (নাম তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি), তার বোন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাদিয়া হক (২৪) এবং শ্যালিকা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী ফারজানা লিজা (২২)। এই দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য এনামুল হক পাটোয়ারী (৪৫), তার ছোট মেয়ে এবং এক শ্যালক গুরুতর আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনাস্থলে এমন দৃশ্য তৈরি হয়েছিল যা বর্ণনা করা কঠিন। মাইক্রোবাসটি বাসের নিচে প্রায় পুরোপুরি ঢুকে যায়। আশপাশের স্থানীয়রা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন। তারা পুলিশকে খবর দেন এবং স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আহতদের দ্রুত চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে এনামুল হকসহ তিনজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল আনোয়ার। তিনি বলেন, “খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। স্থানীয়দের সহায়তায় আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের মরদেহ মালুমঘাট খ্রিস্টান হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, বাসটি অতিরিক্ত গতিতে চলছিল এবং হঠাৎ মাইক্রোবাসটিকে সামনে দেখে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দুর্ঘটনার পরপরই বাসচালক ও তার সহকারী পালিয়ে যায়। পুলিশ বাসটি জব্দ করেছে এবং চালককে আটকের চেষ্টা চলছে।
এনামুল হক পাটোয়ারী চৌদ্দগ্রাম সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর পাটোয়ারীর ছোট ভাই বলে জানা গেছে। পরিবারটি কুমিল্লা থেকে সকাল সকাল কক্সবাজারের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল—উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের সবাইকে নিয়ে দুদিনের অবকাশ যাপন। কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই সেই আনন্দমুখর যাত্রা পরিণত হলো শোকে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলার স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এনামুল হক পাটোয়ারী এলাকার একজন পরিচিত ব্যবসায়ী। সমাজসেবামূলক কাজেও তিনি জড়িত ছিলেন। তার স্ত্রী, মা, বোন ও শ্যালিকার একসঙ্গে মৃত্যুতে গোটা এলাকা এখন শোকে স্তব্ধ। বুধবার দুপুরে দুর্ঘটনার খবর চৌদ্দগ্রামে পৌঁছালে তাদের বাড়িতে শুরু হয় আহাজারি। শোকসন্তপ্ত পরিবারে কেউ সান্ত্বনার কথা বলতে পারছিলেন না।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া। দুই তরুণী শিক্ষার্থী সাদিয়া হক ও ফারজানা লিজা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ বর্ষে ছিলেন। সহপাঠীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন। অনেকেই লিখেছেন—“একটি পরিবারের এতগুলো প্রাণ একসঙ্গে হারিয়ে গেল, এটা কল্পনাতীত।”
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির এমন মর্মান্তিক ঘটনার পর আবারও প্রশ্ন উঠেছে মহাসড়কের নিরাপত্তা ও যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি দেশের অন্যতম ব্যস্ততম রুট। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক এই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। কিন্তু নিয়মিত তদারকি ও অতিরিক্ত গতির কারণে প্রায়ই এমন প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, শুধু চলতি বছরেই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে ৮০টির বেশি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে নিহত হয়েছেন ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ। সংস্থাটি বলছে, পর্যটন মৌসুমে বাস চালকেরা সময় বাঁচাতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ি চালান, যা দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাহমিদা বেগম বলেন, “দুর্ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। একই পরিবারের এতজনের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের দাফন-কাফনের জন্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হচ্ছে।”
স্থানীয়রা জানান, দুর্ঘটনাস্থল হাঁসের দিঘী ঢালায় আগে থেকেই দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। সড়কটি বাঁকানো এবং দুই পাশে উঁচু ঢাল থাকায় বাসচালকেরা প্রায়ই নিয়ন্ত্রণ হারান। এলাকাবাসীর দাবি, সেখানে গতি নিয়ন্ত্রণ চিহ্ন ও সতর্কতা সাইনবোর্ড থাকলেও চালকেরা তা মানেন না।
একই পরিবারের পাঁচ প্রাণ একসঙ্গে নিভে যাওয়ার এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় গোটা দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে এসেছে। যাদের হাসিমুখে ভরা ছুটির যাত্রা ছিল, তারা এখন শীতল মর্গে নিথর দেহ হয়ে শুয়ে আছেন—এমন বেদনাদায়ক পরিণতি আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, দেশের সড়কগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ এবং জীবনের অনিশ্চয়তা কতটা নির্মম হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



