ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনও উদ্বেগজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৬৯ জন রোগী। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়াল ৩০২ জনে, আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৯৯২ জনে।
বুধবার (৫ নভেম্বর) সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। সেখানে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১০ জনের মধ্যে পাঁচজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায়, তিনজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগে একজন করে দুইজন মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকাতেই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিন নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের অর্ধেকের বেশি ঢাকায়। চিকিৎসকরা বলছেন, শহরের পাশাপাশি এখন মফস্বল ও গ্রামীণ এলাকাতেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, যা নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭৬ হাজারে পৌঁছেছে। আক্রান্তদের মধ্যে সর্বাধিক ছিলেন ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। রোগীদের মধ্যে অনেকে জটিল উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন, যেমন রক্তক্ষরণ, শক সিনড্রোম ও প্লেটলেটের মারাত্মক ঘাটতি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, নভেম্বরের শুরুতেও সংক্রমণের হার কমছে না, বরং আবহাওয়ার অনুকূল পরিবেশের কারণে নতুন রোগী বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দিন-রাতের তাপমাত্রার ওঠানামা ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত মশার প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ডেঙ্গুর মশা এডিস এজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিকটাস এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। অনেক এলাকায় নিয়মিত ফগিং ও লার্ভা ধ্বংসের কার্যক্রম কমে যাওয়ায় মশার ঘনত্ব বাড়ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রুবিনা ইয়াসমিন জানান, গত মাসে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ থেকে ৯০০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছিলেন। এখনো সেই সংখ্যা কমেনি। তিনি বলেন, “অনেক নাগরিক নিজস্ব ভবন, বাসাবাড়ি ও অফিস এলাকায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করছেন না। ফলে এডিস মশার বংশবিস্তার অব্যাহত থাকছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৪ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকাতেই ভর্তি আছেন দুই-তৃতীয়াংশের বেশি রোগী। অধিকাংশ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিতফোর্ড হাসপাতাল ও শহরের বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম এখনো শেষ হয়নি। শীতের আগ পর্যন্ত সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। তারা নাগরিকদের সতর্ক থাকতে আহ্বান জানাচ্ছেন—বাড়ির আশপাশে জমে থাকা পানি ফেলে দেওয়া, ফুলের টব, ড্রাম, পরিত্যক্ত টায়ার ও ফ্রিজের ট্রেতে পানি না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
সরকারি নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি ওয়ার্ডে নিয়মিত মশক নিধন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে কঠোর মনোভাব নিতে হবে। তবুও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশঙ্কা করছে, চলতি মাসে সংক্রমণ না কমলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজধানী ঢাকায় জনঘনত্ব, অপরিকল্পিত আবাসন এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রধান অন্তরায়। প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা ও স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত তদারকি ছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, “ডেঙ্গু এখন মৌসুমি নয়, প্রায় সারা বছরই দেখা দিচ্ছে। এজন্য নাগরিকদের স্থায়ী প্রতিরোধমূলক অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।”
এদিকে চিকিৎসকরা আবারও সতর্ক করে বলেছেন, ডেঙ্গু রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে অবহেলা মারাত্মক হতে পারে। জ্বরের প্রথম তিন দিনের মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা শুরু করলে জটিলতা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব।
সব মিলিয়ে, নভেম্বরেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এই অবস্থায় প্রশাসন, সিটি করপোরেশন ও নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া মৃত্যুহার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



