ছবি: সংগৃহীত
চলতি বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা চার শতাধিক ছাড়িয়েছে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও পৌঁছে গেছে লাখের ঘরে। প্রতিদিনই পাঁচশর বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এমন সংকটজনক পরিস্থিতিতেও সরকারের কার্যক্রমে দেখা যাচ্ছে উদাসীনতা। বিপুলসংখ্যক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর পরও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। ডেঙ্গুতে শত শত মানুষের মৃত্যু যেন এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, সরকারের উদাসীনতার কারণেই ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। অবহেলা ও প্রস্তুতির ঘাটতিতে ডেঙ্গু এখন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন হাসপাতালে ছুটছে বিপুলসংখ্যক রোগী ও তাদের স্বজনরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৪৯৩ জনে। এদের মধ্যে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নারী। এখন পর্যন্ত ৯৭ হাজার ৬৫৩ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মারা গেছেন ৪০৪ জন—এর মধ্যে পুরুষ ৫২ দশমিক ২ শতাংশ এবং নারী ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১ হাজার ৪৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী। তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪০৪ জনের। তার মধ্যে ডিসেম্বরের গত ১১ দিনেই মারা গেছে ২২ জন। এর আগে নভেম্বর মাসে মৃত্যু হয় ১০৪ জনের। অক্টোবর মাসে ৮০ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার আগে আগস্টে ৩৯ জনের, জুলাই মাসে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। জুন মাসে ১৯ জন, মে মাসে তিনজন, এপ্রিলে সাতজন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন ও জানুয়ারিতে ১০ জনের মৃত্যু হয় ডেঙ্গুতে। মার্চ মাসে কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। অন্যদিকে ডেঙ্গুতে চলতি জানুয়ারিতে ১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিলে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন, এ ছাড়া জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫১ জন, জুলাইয়ে ১০ হাজার ৬৮৪, আগস্টে ১০ হাজার ৪৯৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ১৫ হাজার ৮৬৬ জন, অক্টোবরে ২২ হাজার ৫২০ জন, নভেম্বর মাসে ২৪ হাজার ৫৩৫ জন ও ডিসেম্বরের গত ১১ দিনে ৫ হাজার ৯৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় এই সরকার চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা অতীতে যেমন উদাসীনতা দেখেছি, এত বড় বিপ্লবের পরও পুরোনো ধারায় ডেঙ্গুর মতো জনস্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে সেই একই ধরনের উদাসীনতা দেখলাম। বিষয়টা আমাদের জাতির জন্য সত্যি বড় দুঃখজনক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল জরুরি ভিত্তিতে একটা সমন্বিত রিভিউ সভার আয়োজন করা। কেন এই মৃত্যুর মিছিল ঠেকানো যাচ্ছে না, তা পর্যালোচনা করা। শীতে এসেও ডেঙ্গু কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সেইসঙ্গে ডেঙ্গু জরুরি অবস্থা জারি করা যেত। কিন্তু তারা সেটা করছে না। এসব করলে হয়তো আমরা আগামী বছরগুলোয় পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা স্থানীয় সরকার সবাই নির্লিপ্ত। তাদের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। স্থানীয় সরকার মশক নিধনে পুরোপুরি ব্যর্থ। তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ডেঙ্গু এমন একটি রোগ, এটি নিয়ন্ত্রণের কোনো উপায় নেই। এ রোগে নাগরিকদের মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এ জন্য সরকারের কোনো দায়িত্ব কিংবা দায় নেই। এই সরকার তো আর বেশিদিন নেই। তবে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, আগামী বছর যেহেতু নির্বাচন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ডেঙ্গুর মতো জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের পরিকল্পনা ও গুরুত্ব দেবে। সেইসঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাহলে হয়তো দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা কমবে।’
এক দিনে আরও তিনজনের মৃত্যু, ৪১১ জন হাসপাতালে: ডেঙ্গুতে এক দিনে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময় আরও ৪১১ জন নতুন রোগী রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪৬৪ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৪১১ জনের মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৬১ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৬ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৯৯ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭০ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২৬ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২০ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২১ জন, রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) দুজন এবং সিলেট বিভাগে ছয়জন রোগী রয়েছে। এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে পুরুষ রোগী ৬৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং নারী ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ।
এর আগে ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। ওই বছর রোগটিতে মারা যায় ৫৭৫ জন। তারও আগে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৭০৫ জনে, আর ওই বছরে হাসপাতালে ভর্তি হয় মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



