
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ প্রকৃতি ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, রহস্যময় সুন্দরবন, মেঘের ভেলায় ভাসা সাজেক, পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, কাপ্তাই লেক, সবুজে মোড়ানো চা-বাগান, ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ, মহাস্থানগড়, খানজাহান আলীর মাজারের মতো অগণিত প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পদ এ দেশের একেকটি রত্ন। এই বৈচিত্র্যময় পর্যটন সম্পদ দেশের অর্থনীতিকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করেও পর্যটন খাত এখনো টলমল অবস্থায়। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাবনা হারাচ্ছে, ক্রমেই খাদের কিনারে চলে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যটন খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। ২০২০ সালে অফিশিয়াল-এস্তা ডট কম নামের একটি ওয়েবসাইট তথ্য প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন বিদেশি পর্যটকের বিপরীতে কর্মসংস্থান হয় ৯৪৪ জনের—যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। এ থেকে বোঝা যায়, বিদেশি পর্যটক বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান বলেন, “বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা সীমাহীন। কিন্তু পরিকল্পনা ও পেশাদারিত্বের অভাবে এই খাতটি অর্থনীতির চালিকাশক্তি হতে পারছে না। সঠিক নীতি থাকলে শুধু পর্যটন দিয়েই আমরা নতুন অর্থনৈতিক অধ্যায় শুরু করতে পারতাম।”
পর্যটন খাতের বিপর্যস্ত অবস্থার কারণ অনেক। নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপরিকল্পিত অবকাঠামো, পেশাদার সেবার অভাব, অস্বাভাবিক হারে হোটেল ভাড়া, তথ্যের ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—সব মিলিয়ে বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত গন্তব্য।
কক্সবাজারের নিড বে ওয়াচ হোটেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল আমিন বলেন, “থাইল্যান্ডে সারা বছর পর্যটক থাকে। তারা শুধু সমুদ্রের সৌন্দর্য নয়, নানা ধরনের বিনোদন উপভোগ করে। কক্সবাজারে সাগর দেখা ছাড়া করার কিছু নেই। নাইট লাইফ নেই, বিনোদন নেই। সন্ধ্যার পর পর্যটকরা হোটেল কক্ষেই বন্দি থাকেন।”
২০২০ সালে আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবালকে দিয়ে প্রায় ২৮ কোটি টাকা খরচে পর্যটনের মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সারা দেশে ১ হাজার ৪৯৮টি পর্যটন সম্পদ চিহ্নিত করে অঞ্চলভিত্তিক হাব ও উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। আশা করা হয়েছিল, ২০৪১ সালের মধ্যে বছরে অন্তত ৫৫ লাখ বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে দুই কোটির বেশি মানুষের।
কিন্তু বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, মহাপরিকল্পনাটি এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়। বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর খসড়াটি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি রিভিউ কমিটি গঠন করেছে। তবে কবে নাগাদ জাতীয় পর্যটন কাউন্সিলে অনুমোদন হবে—সেই নিশ্চয়তা নেই।
বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং মহেশখালীতে সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এখানে পাঁচ তারকা হোটেল, সি-ক্রুজ, ভাসমান রেস্তোরাঁ, কেবল কারসহ আন্তর্জাতিক মানের নানা বিনোদন সুবিধা থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রকল্প অগ্রগতি হারিয়ে ঝুলে গেছে।
সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্কের জমি বন্দোবস্ত বাতিল করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। নাফ ট্যুরিজম পার্কের নামই আর শোনা যায় না। সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের কাজও নজরের অভাবে সাগরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ছিল ৪২১ মিলিয়ন ডলার। ইতোমধ্যে খরচ হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি) বলছে, বৈশ্বিক জিডিপিতে পর্যটনের অবদান ১০ শতাংশের বেশি হলেও বাংলাদেশে এর অবদান মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কা পর্যটন খাত থেকে আয় করেছে ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, ভারত ২৯ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন, মালদ্বীপ ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন, পাকিস্তান ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন। সেখানে বাংলাদেশের আয় ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৪০১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের অবস্থান আরও শোচনীয় ভ্রমণ ও পর্যটন সূচকে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম।
বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যটন খাতের সম্ভাবনা অগাধ হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।
-
কক্সবাজার : সৈকতে কোনো লাইফগার্ড নেই, সন্ধ্যার পর বিনোদনের অভাব, হোটেল-যানবাহনের ভাড়া অস্বাভাবিক বেশি।
-
সুন্দরবন : ডাকাত দলের উৎপাত ও নিরাপত্তাঝুঁকির কারণে কাঙ্ক্ষিত পর্যটক পাওয়া যাচ্ছে না।
-
রাঙামাটি : ঝুলন্ত সেতু পানির নিচে, নেই ভালো টয়লেট, বিশ্রামাগার বা আধুনিক সুযোগসুবিধা।
-
সিলেট : জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি অবৈধ বালু-পাথর উত্তোলনে ধ্বংসের পথে।
-
কুয়াকাটা : সাগরের ভাঙনে সৈকত ছোট হয়ে মূল বেড়িবাঁধে ঠেকেছে।
-
হাওর অঞ্চল : জনপ্রিয় হাউসবোট এলেও মৌলিক সুবিধার অভাব প্রকট।
-
মৌলভীবাজার : ২০০৮ সালে পর্যটন জেলা ঘোষণার পরও কোনো দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়নি।
পর্যটন এখন সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় গুরুত্ব পাচ্ছে না। বাজেট কম, পেশাদার নেতৃত্বের অভাবও প্রকট।
অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, “পর্যটন খাত নিয়ে আলাদা মন্ত্রণালয় হওয়া উচিত ছিল। এখানে যারা দায়িত্বে থাকেন, তাদের বেশিরভাগেরই পর্যটন বিষয়ে পড়াশোনা নেই। ফিজিক্স, বায়োলজি বা ইসলামের ইতিহাসের ছাত্র পর্যটন বোঝেন না। ফলে পরিকল্পনায় ঘাটতি থাকে।”
-
বেঙ্গল লজিস্টিকস লিমিটেডের এমডি এম রফিকুল ইসলাম নাছিম বলেন, “পর্যটনের সঙ্গে কৃষি, হস্তশিল্প, পরিবহনসহ অসংখ্য খাত জড়িত। কিন্তু আমাদের কোনো ব্র্যান্ডিং নেই। হোটেল-খাবারের খরচ এত বেশি যে ব্যাকপ্যাক ট্যুরিস্টরা আসতে চায় না।”
-
কক্সবাজারের হোটেল উদ্যোক্তারা বলছেন, “সাগরই এখানে একমাত্র আকর্ষণ। বিদেশি পর্যটকদের জন্য বৈচিত্র্যময় বিনোদন তৈরি করা জরুরি।”
-
পরিবেশবিদরা মনে করেন, “সেন্ট মার্টিন হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। পরিবেশ রক্ষায় পর্যটকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্য দেশে সেটাই হচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ যদি সীমিত সংখ্যক পর্যটন স্পটকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নয়ন করে, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ ভ্রমণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এবং ব্র্যান্ডিংয়ে জোর দেয়, তবে পর্যটন খাত দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে রূপ নিতে পারে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় পর্যটন খাত দিশেহারা, নেতৃত্বহীন ও পরিকল্পনাহীন হয়ে ক্রমেই খাদের কিনারে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ