ছবি: সংগৃহীত
বিমান নিরাপত্তা এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে সামান্যতম অবহেলাও প্রাণঘাতী হতে পারে। আর সেই নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ—পাইলট লাইসেন্সিং ও সার্টিফিকেশন—যদি অযোগ্য, লাইসেন্সহীন বা নন-কারেন্ট কর্মকর্তাদের হাতে থাকে, তবে পুরো আকাশপথই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ঠিক এমনই স্পর্শকাতর, বিতর্কিত ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি বিরাজ করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ভেতরে। দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন এফওআই (ফ্লাইট অপারেশনস ইন্সপেক্টর) নিয়োগ, তাঁদের যোগ্যতা সংকট, এবং লাইসেন্সবিহীন কর্মকর্তাদের দ্বারা পাইলটদের লাইসেন্স ইস্যু—সব মিলিয়ে বিমান খাতের সবচেয়ে বড় প্রশ্নবিদ্ধ অধ্যায় বলতে দ্বিধা নেই।
লাইসেন্সহীন কর্মকর্তারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন লাইসেন্সিং!
পাইলটদের লাইসেন্স প্রদান বা নবায়ন একটি অত্যন্ত জটিল ও সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। এর জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত, অভিজ্ঞ, কারেন্ট ফ্লাইং আওয়ার থাকা এবং বৈধ এয়ারলাইন ট্রান্সপোর্ট পাইলট লাইসেন্স (এটিপিএল)ধারী ইন্সপেক্টর। কিন্তু বাংলাদেশে এ দায়িত্ব পালন করছেন এমন কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশের নিজেদের বৈধ লাইসেন্সই নেই বহু বছর।
বেবিচকের তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে ছয়জন এফওআই দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের লাইসেন্স বহু আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। একজনের লাইসেন্সের বয়স অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে, আবার অনেকে বয়সের কারণে ‘প্রিভিলেজ এক্সারসাইজ’ করতে অক্ষম। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হল—অনেকের প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সার্টিফিকেশন নেই, নেই টাইপ রেটিং হালনাগাদ রেকর্ড।
যে সংস্থা নিজে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানছে না, তারা কীভাবে আন্তর্জাতিক রুটে অপারেট করা এয়ারলাইন্সগুলোর নিরাপত্তা যাচাই করবে—এই প্রশ্ন উঠছে জোরালোভাবে।
আইকাও মানদণ্ডের সরাসরি লঙ্ঘন
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (ICAO) ডক ৮৩৩৫ অনুযায়ী, লাইসেন্স ইস্যু, নবায়ন, চেক রাইড, সিমুলেটর টেস্ট বা অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত যেকোনো ইন্সপেক্টরের বৈধ পাইলট লাইসেন্স ও বর্তমান টাইপ রেটিং বাধ্যতামূলক।
কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, বেবিচকের অধিকাংশ ইন্সপেক্টরই এই যোগ্যতা পূরণ করেন না। একজনের লাইসেন্স ২০০৬ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ, আরেকজনের ২০১৫ সালে। কারো কারো বয়স ৭৪–৭৬, যেটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বহু ওপরে। আবার অনেকের কমার্শিয়াল এয়ারলাইন অভিজ্ঞতাই নেই।
একজন গুরুত্বপূর্ণ ইন্সপেক্টর ফেরদৌস হোসেনের লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে ৬৮ বছর বয়সে, অথচ কোনো মেডিক্যাল ডকুমেন্টই বেবিচক চাননি—যা সরাসরি আইকাও লঙ্ঘন।
নতুন নিয়োগেও অনিয়ম—যোগ্যতার মানদণ্ড বাদ
বেবিচক সম্প্রতি এফওআই নিয়োগের জন্য নতুন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সেখানে সবচেয়ে বিতর্কিত পরিবর্তন হলো—
■ বৈধ পাইলট লাইসেন্স আবশ্যক নয়
■ টাইপ রেটিং প্রয়োজন নেই
■ বয়সসীমা উল্লেখ নেই
■ পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার বাধ্যবাধকতা বাতিল
এটি শুধু আইকাও নয়, বেবিচকের নিজস্ব সিভিল এভিয়েশন প্রসিডিউরেরও সম্পূর্ণ বিপরীত। পাবলিক প্রোকিউরমেন্ট রুলস অনুযায়ী কনসালট্যান্ট পদের যোগ্যতা কমিয়ে এইচএসসি পর্যন্ত নামিয়ে আনা হয়েছে—যা নিয়মবহির্ভূত বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিমান খাতের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা বলছেন—যোগ্যতা না থাকা ইন্সপেক্টর নিয়োগ হলে পরবর্তী আইকাও অডিটে বাংলাদেশ ‘সিগনিফিক্যান্ট সেফটি কনসার্ন’ (SSC) এর মুখোমুখি হবে। এর ফলে দেশের কোনো এয়ারলাইনই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, রুট সম্প্রসারণ বা নতুন বিমান কেনার অনুমতি পাবে না।
লাইসেন্সহীন ইন্সপেক্টরদের ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ
বেবিচকের সিকিউরিটি পাসধারী হওয়ায় এফওআইরা ভিসা ও টিকিট ছাড়াই বিদেশ ভ্রমণ করতে পারেন ‘জেনারেল ডিক্লারেশন (GD) পাস’ দিয়ে। অভিযোগ রয়েছে—কিছু ইন্সপেক্টর এই সুযোগ ব্যক্তিগত কাজে অপব্যবহার করেন, অথচ কোনো সরকারি অনুমতি ছাড়াই বিদেশে গিয়ে অডিট করেন।
এর ফলে বেবিচকের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ বিমান নিরাপত্তায় অনিয়মের কথা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
যোগ্য কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অভিযোগ
বেবিচকের ভেতরে গ্রুপিং, ব্যক্তিগত স্বার্থ ও খুচরা রাজনীতি দীর্ঘদিনের সমস্যা। অভিযোগ রয়েছে— যাদের বৈধ লাইসেন্স, ক্লাস–১ মেডিক্যাল এবং চাহিদা অনুযায়ী অভিজ্ঞতা ছিল, তাঁদের চুক্তি নবায়ন করা হয়নি।
যেমন—সাবেক এফওআই আজিজ আব্বাসী রফিক ও কাজী কবির উদ্দিন আহমেদ।
অন্যদিকে অযোগ্য, লাইসেন্সবিহীন ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের চুক্তি নবায়ন করা হয়েছে ৪৬ জনের, যা বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বিরোধী।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা: “বাংলাদেশ ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে”
দেশের বিমান খাতের বিশিষ্ট বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুতর বলে মনে করছেন।
এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বাংলাবার্তাকে বলেন, “যাঁদের নিজেদের বৈধ লাইসেন্স নেই, তাঁরা কীভাবে অন্যের লাইসেন্স ভ্যালিডেট করবেন? এটি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন। এর ফলে আইকাও অডিটে বাংলাদেশ বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।”
বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন (অব.) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, “পাইলট লাইসেন্সিং হলো একটি ‘সেফটি–ক্রিটিক্যাল অ্যাকটিভিটি’। যেখানে যে ব্যক্তি নিজের গ্রাউন্ড ক্লিয়ার করতে পারেন না, তিনি অন্যের উড্ডয়ন নিরাপত্তা মূল্যায়ন করতে গেলে তা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। এখানে সিস্টেমেটিক ব্যর্থতা ঘটেছে।”
বিমান নিরাপত্তা গবেষক ড. ফারমান হক বলেন, “এফওআইদের লাইসেন্সহীনতা বা নন-কারেন্ট থাকা মানে বিমান নিরাপত্তার মৌলিক ধারণাই ভেঙে পড়া। অডিটিং প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়ে যায়, যার প্রভাব আন্তর্জাতিক রুট, কোড-শেয়ার চুক্তি, বিমান ভাড়া, বীমা—সবকিছুতেই পড়বে।”
বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন বিশেষজ্ঞ রুবাইয়াত হোসেন বলেন, “আইকাও যদি বাংলাদেশকে ‘SSC’ দেয়, তবে বাংলাদেশের সব এয়ারলাইনকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ রুটে ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে হতে পারে।”
বেবিচকের ব্যাখ্যা: “অ্যাক্টিভ পাইলট হওয়ার বাধ্যবাধকতা সবার জন্য নয়”
বেবিচকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মাদ কাউছার মাহমুদ বলেন— “আইকাও ডকুমেন্ট অনুযায়ী সব এফওআইয়ের অ্যাক্টিভ পাইলট হওয়ার দরকার নেই। কেউ লাইসেন্স–সংক্রান্ত কাজ করেন, কেউ করেন টেকনিক্যাল বা নন–ফ্লাইং বিষয়।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—এ ব্যাখ্যা ভুল, বিভ্রান্তিকর এবং মূল সমস্যাকে আড়াল করার চেষ্টা।
সামনে কী বিপদ?
বিশ্লেষকদের মতে, যদি দ্রুত এই সংকট সমাধান না করা হয়—
-
বাংলাদেশকে ICAO ‘SSC’ দিতে পারে
-
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ঝুঁকির মুখে পড়বে
-
বিমান কেনা–বেচা, রুট সম্প্রসারণ বন্ধ হতে পারে
-
FAA ও EASA নিরাপত্তা মূল্যায়নে বাংলাদেশ ব্যর্থ হতে পারে
-
বীমা প্রিমিয়াম বাড়বে, আর্থিক ক্ষতি হবে এয়ারলাইনসগুলোর
-
দেশের বিমান বহর আধুনিকায়নে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে
সব মিলিয়ে বেবিচকের এই অনিয়ম কেবল একটি প্রশাসনিক ত্রুটি নয়—এটি সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সুনামের সঙ্গে জড়িত।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



