ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাবৃত্তি, চিকিৎসা, পর্যটন ও কর্মসংস্থানের অন্যতম বড় ক্ষেত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক এক বছরে পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। কোনো আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের বহু দেশ বাংলাদেশিদের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে বা অস্বাভাবিকভাবে প্রক্রিয়া দীর্ঘ করছে। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী, পর্যটক, চাকরিপ্রত্যাশী—প্রায় সব শ্রেণির নাগরিকই। ভিসা–সংকটের কারণে সুযোগ হারাচ্ছেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ট্যুরিজম ও শ্রমবাজার।
এবার বিশদভাবে দেখা যাক—কেন এই সংকট তৈরি হলো, কোন দেশগুলো ভিসা দিচ্ছে না, ভিসা পাওয়ার হার কেন কমছে, এবং কীভাবে এই জটিলতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা সংকট: উদাহরণ থেকে বাস্তবতা
বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে যেসব শিক্ষার্থী দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন, তাদের জন্য গত এক বছর হয়ে উঠেছে সবচেয়ে কঠিন সময়। হাঙ্গেরি এবং যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যাওয়ার সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করেও শেষ মুহূর্তে ভিসা না পাওয়ায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ হারিয়েছেন তানজুমান আলম ঝুমা—এমন ঘটনা এখন আর বিচ্ছিন্ন নয়।
তিনি জানান—
-
বুদাপেস্টে আবেদন করেছিলেন অক্টোবর মাসে।
-
জানুয়ারিতে আসে ‘নো’।
-
এরপর একই বছর যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করেও ফলাফল একই।
-
পুরো এক বছর ব্যয় হয়েছে কাগজপত্র, আবেদন ও অপেক্ষায়।
তার মতো আরও শত শত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী স্কলারশিপ পেয়েও ভিসা–প্রত্যাখ্যানের কারণে বিদেশ যেতে পারছেন না। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, হাঙ্গেরি, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্টুডেন্ট ভিসা–প্রত্যাখ্যানের হার বেড়েছে বহু গুণ।
পর্যটক ও শ্রমিকদের ভিসাও জটিল: সর্বত্র একই চিত্র
শুধু শিক্ষার্থী নয়—পর্যটক ও বিদেশগামী শ্রমিকদের ক্ষেত্রেও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে readিয়েছে। অনেকে বহু দেশ ঘোরার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হলেও হঠাৎ করেই পাচ্ছেন না ভ্রমণ বা কর্মসংস্থান ভিসা।
পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন সংকট অতীতে দেখা যায়নি। একসময়ের ‘সহজ’ ভিসার দেশগুলো এখন আবেদনই নিচ্ছে না বা আবেদন নিলেও অনুমোদন দিচ্ছে না।
কোন কোন দেশ ভিসা দিচ্ছে না?
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)–এর সভাপতি মো. রাফেউজ্জামানের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, নিচের দেশগুলো এখন কার্যত বাংলাদেশিদের ভ্রমণ/কাজের ভিসা দিচ্ছে না বা অত্যন্ত সীমিত দিচ্ছে:
পুরোপুরি বা প্রায় বন্ধ
-
ভারত (পর্যটন ভিসা; আগস্ট ২০২৪ অভ্যুত্থানের পর)
-
ইউএই
-
কাতার
-
বাহরাইন
-
ওমান
-
উজবেকিস্তান
-
সৌদি আরব
-
ভিয়েতনাম
অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে
-
থাইল্যান্ড
-
ফিলিপাইন
-
শ্রীলঙ্কা (আগে আগমনী ভিসা দিত, এখন ই–ভিসা করতে ২–৩ দিন অপেক্ষা)
ভিসা–অনুপাত কমছে
-
সিঙ্গাপুর
-
মালয়েশিয়া
ভিসা ফি বাড়িয়েছে
-
ইন্দোনেশিয়া
এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতেও ভিসা–প্রাপ্তির হার আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার পরিস্থিতি: হঠাৎ ভিসা কমে যাওয়া
পর্যটন ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন সেলিম জানান—
-
যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত বছরে ৫–৬ লাখ B1/B2 ভিসা দেয়।
-
কিন্তু ২০২4–২৫ সালে এই সংখ্যা নেমে এসেছে প্রায় ২ লাখে।
-
অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ২০২৩–২৪ সালে প্রচুর ভিসা দিলেও এবার প্রায় দিচ্ছে না।
এটি কেন হচ্ছে? নিচে বিশ্লেষণ দেওয়া হলো।
ভিসা প্রত্যাখ্যানের গভীর কারণ: কেন কঠোর হচ্ছে দেশগুলো?
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভিসা–সংকটের পেছনে বাংলাদেশি পাসপোর্টের দুর্বলতা বা রাজনৈতিক অস্থিরতা আংশিক দায়ী হলেও মূল কারণ আরও বহুস্তরীয়। বিস্তারিতভাবে কারণগুলো হলো—
১. ভিসার অপব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে যাওয়া
অনেক বাংলাদেশি—
-
ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বিদেশে গিয়ে অনিয়মিতভাবে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেন,
-
সহজ ভিসার দেশ যেমন ভিয়েতনাম/থাইল্যান্ডে গিয়ে সেখান থেকে অন্য দেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেন,
-
ভিসা–নীতিকে ‘ট্রানজিট রুট’ হিসেবে ব্যবহার করেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন— “ভিসা পাওয়ার সুযোগকে অনেকে অপব্যবহার করছেন। ফলে যেসব দেশে অভিবাসনবিরোধী পরিবেশ নেই, তারাও সতর্ক হয়ে গেছে।”
২. অসাধু ব্যবসায়ীদের ভিসা–দালালি ও শ্রমিক পাচার
অনেক দালাল—
-
ভ্রমণ ভিসায় মানুষকে বিদেশে পাঠান
-
পরে সেটিকে শ্রমিক ভিসায় রূপান্তরের চেষ্টা করেন
ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বাংলাদেশিদের সব ভিসাই সন্দেহের চোখে দেখছে।
৩. বিদেশে রাজনৈতিক কর্মীদের সংঘর্ষ ও বিতর্ক
ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য—বহু দেশে বাংলাদেশি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রকাশ্য সংঘর্ষ, উত্তেজনা, মিছিল-মিটিং স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্বিগ্ন করেছে।
ফলে দেশগুলোর দৃষ্টিতে বাংলাদেশিদের—
-
ঝুঁকিপূর্ণ,
-
বিতর্কিত,
-
বা রাজনৈতিকভাবে সংঘাতপ্রবণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
৪. পাসপোর্টের র্যাংকিং নিচে নেমে যাওয়া
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের র্যাংকিং অনুযায়ী—
-
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল পাসপোর্টের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।
-
বাংলাদেশি নাগরিকরা ভিসামুক্তভাবে যেতে পারেন মাত্র ৩৮টি দেশে, যেগুলোর বেশির ভাগই আফ্রিকা/ক্যারিবীয় অঞ্চলের।
দুর্বল র্যাংকিং মানেই বেশি সন্দেহ, বেশি যাচাই, বেশি ঝুঁকি মূল্যায়ন।
৫. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অভিবাসন–চাপ
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরের অনিশ্চিত পরিস্থিতি—
-
কিছু দেশে বাংলাদেশিদের ভ্রমণ ভিসাকে রাজনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত করেছে,
-
একই সঙ্গে অনেক নাগরিক বিদেশে পালাতে চাইবে—এই আশঙ্কায় দেশগুলো আরও সতর্ক হয়েছে।
৬. ভারতের ভিসা নিয়ন্ত্রণের প্রভাব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়া
ভারত আগস্ট ২০২৪–এ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের পর্যটন ভিসা বন্ধ করে দেয়।
এতে—
-
অন্য দেশগুলোও বাংলাদেশিদের বিষয়ে আরও সতর্ক হয়ে যায়,
-
বিশেষ করে নিকটবর্তী এশীয় রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা ঝুঁকি বেশি বিবেচনা করে।
এই সংকটের সবচেয়ে বড় শিকার কারা?
১. শিক্ষার্থীরা
স্কলারশিপ পাওয়ার পরও যেতে না পারা শত শত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
২. পর্যটন ব্যবসায়ী ও ট্যুর অপারেটররা
ভিসা না পাওয়ায় ট্যুর প্যাকেজ হচ্ছে বাতিল, প্রতিষ্ঠানগুলো পড়ছে বড় ক্ষতিতে।
৩. প্রবাসগামী শ্রমিকরা
মধ্যপ্রাচ্যে ভিসা–নিয়ম কঠোর হওয়ায় অনেক শ্রমিক কয়েক লাখ টাকা দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন।
৪. বিদেশভ্রমণ নির্ভর ব্যবসা
এয়ারলাইন, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল বুকিং—সবই ক্ষতিগ্রস্ত।
সমাধানের পথ: কী করলে সংকট কাটবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকট কোনো সাময়িক নয়; এর গভীর রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ইমিগ্রেশন–সংক্রান্ত শিকড় আছে। সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি—
১. দেশের ভেতরে ভিসা–অপব্যবহার বন্ধে কঠোর ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা
এম হুমায়ুন কবির বলেন— “দেশের ভেতরে যারা ভিসার অপব্যবহারে জড়িত—ব্যক্তি বা এজেন্সি—তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে। তবেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আস্থা ফিরবে।”
২. কূটনৈতিক উদ্যোগ দ্রুত বাড়ানো
-
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভিসা সেন্টার শুধু দিল্লিতে রেখে জটিলতা বাড়ানোর বিষয়টি আগে আলোচনায় হয়েছিল।
-
কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও ফল আসেনি।
-
বিদেশ মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও নীতি–নির্ধারণে স্বচ্ছতা আনা
নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে ভারতের ভিসা–সংকট দূর হবে বলে আশা করা হলেও—
অন্যান্য দেশে ভিসা–প্রত্যাখ্যান কমাতে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
৪. বৈধ অভিবাসনের পথ সহজ করা
-
সরকারি তত্ত্বাবধানে বিদেশগামী শ্রমিকদের যাচাই
-
দালালমুক্ত অভিবাসন ব্যবস্থা
-
শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ‘ফাস্ট–ট্র্যাক’ ভিসা কাউন্টার
৫. আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করা
বিদেশে—
-
রাজনৈতিক সংঘর্ষ
-
সমাবেশ
-
দলীয় মারামারি
-
আইন লঙ্ঘন
-
বেআইনি অবস্থান
এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে সংকট আরও বাড়বে।
বাংলাদেশিদের ভিসা সংকট একদিনে তৈরি হয়নি, আবার একদিনে কাটবেও না। এটি বহু বছরের অভিবাসন–অপব্যবহার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দালালচক্রের প্রতারণা, দুর্বল পাসপোর্ট এবং আন্তর্জাতিক অনাস্থার মিলিত ফল। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে—কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা না দিলেও বাস্তবে অনেক দেশ ভিসা প্রক্রিয়ায় ‘অঘোষিত কঠোরতা’ চালু করেছে।
সমাধানের জন্য জরুরি:
-
দেশের ভেতরে কঠোর ব্যবস্থা
-
কূটনৈতিক উদ্যোগ
-
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
-
অভিবাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা
এসব একসঙ্গে না ঘটলে এই সংকট দীর্ঘায়িত হবে, এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ বাংলাদেশিরাই।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



