ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ প্রতীক্ষা, জল্পনা ও রাজনৈতিক উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তার এই প্রত্যাবর্তনকে দেশের রাজনীতিতে একটি যুগান্তকারী ও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুধী সমাজ এবং বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিভক্ত ও বিবদমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারেক রহমানের দেশে ফেরা কেবল একটি দলীয় ঘটনা নয়, বরং এটি জাতীয় রাজনীতির গতিপথ বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বড় একটি অংশ মনে করছেন, বর্তমান সময়ে দেশের রাজনীতিতে যে মেরুকরণ, অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে তারেক রহমানের ভূমিকা নির্ধারক হতে পারে। নির্বাচনের আগে ও পরে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সহিংসতা পরিহার, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা—এই সব কিছুর দায় অনেকাংশেই তার কাঁধে এসে পড়ছে। ফলে বিএনপির এই শীর্ষ নেতার প্রত্যাবর্তনের দিকে শুধু দলীয় নেতাকর্মীরাই নয়, গোটা দেশই তাকিয়ে আছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, তারেক রহমান দেশে ফেরার পর রাজনীতিতে কিছু ‘চমকপ্রদ’ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। বিশেষ করে আসন সমঝোতা, জাতীয় ঐক্যের ডাক, এমনকি নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠনের বিষয়টিও আলোচনায় আনতে পারেন তিনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে, প্রয়োজন হলে তিনি নিজ দলের প্রার্থীদের কিছু আসন ছাড় দিয়ে হলেও একটি শান্তিপূর্ণ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির উদ্যোগ নিতে পারেন।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিএনপির ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফার প্রথম দফাতেই ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে জয়ী হয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করা হবে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়েও বিভিন্ন সভা, সমাবেশ ও সেমিনারে তারেক রহমান এই ৩১ দফার কথা বারবার তুলে ধরেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরা রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তিনি বলেন, “আগামী ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। তারেক রহমান দেশে ফিরলে হাতে চার দিন সময় থাকবে। এই স্বল্প সময়েই অনেক কিছু পাল্টে যেতে পারে—মনোনয়নকেন্দ্রিক বিরোধ মীমাংসা, শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি কিংবা বৃহত্তর ঐক্যের ডাক—সবই সম্ভব।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় যে ধরনের শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছে, তার বিপরীতে বিএনপিকে সরকার গঠন করলে সুশাসনের একটি ভিন্ন মডেল উপস্থাপন করতে হবে। বিএনপি কেন আলাদা, কেন তারা দেশের জন্য ভরসার জায়গা—এটি প্রমাণ করতে হবে। মাঠে-ময়দানে দেওয়া অঙ্গীকারগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়াই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।”
বর্তমান বাস্তবতায় তারেক রহমান দেশে ফিরছেন এমন এক সময়ে, যখন দেশে বিচ্ছিন্নভাবে সহিংসতা, মব ভায়োলেন্স এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা বিদ্যমান। এরই মধ্যে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে একটি শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে সম্ভব হবে—সে প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, “দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব অনেক বেশি। জনগণের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে বিএনপিই ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হলো ক্ষমতায় থেকে দেশকে স্থিতিশীল রাখা। এই দায়িত্ব পালনে তারেক রহমানকে অত্যন্ত সতর্ক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দূরদর্শী ভূমিকা নিতে হবে।”
সুধী সমাজের অনেকেই মনে করছেন, তারেক রহমানের বক্তব্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ইঙ্গিত রয়েছে। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এক মতবিনিময় সভায় বলেন, “দেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা বিপজ্জনক। এই শূন্যতা পূরণে তারেক রহমানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও আগে দেশে ফিরলে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হতে পারত।”
রাজনীতিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হলো নির্বাচনি সমঝোতা। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সমঝোতার নজির রয়েছে। এবারও নির্বাচনি সমঝোতা হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল হবে—সে প্রশ্নও ঘুরে ফিরে আসছে। যদিও বিএনপি ইতোমধ্যে তিনশ আসনের প্রায় ৯০ শতাংশে মনোনয়ন দিয়েছে, তবুও শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন এবং ভেতরের রাজনৈতিক উত্তেজনা—সব মিলিয়ে একটি বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে ঘিরে নানা গুজব ও শঙ্কাও ছড়াচ্ছে। তাদের মতে, এই জটিল অবস্থা সামাল দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরির সক্ষমতা এই মুহূর্তে একমাত্র তারেক রহমানেরই আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, “বিএনপি সরকারে গেলে আন্দোলনে অংশ নেওয়া দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি আগেই দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনেও শরিকদের কিছু আসন ছাড় দেওয়া হবে। তারেক রহমান যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা বলছেন, তা কেবল বক্তব্যে নয়, ক্ষমতায় গেলেও বাস্তবায়ন হবে।”
এদিকে তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন ঘিরে দলীয় প্রস্তুতিও তুঙ্গে। রাজধানীর তিনশ ফিট এলাকায় সংবর্ধনাস্থল পরিদর্শন করেছেন বিএনপির নেতারা। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে, মঞ্চ প্রস্তুতসহ সব আয়োজন প্রায় শেষ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস জানান, তারেক রহমানের আগমন উপলক্ষে কোনো আনুষ্ঠানিক গণজমায়েতের আহ্বান না থাকলেও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি থাকবে বলে তারা আশা করছেন।
তারেক রহমানের দেশে ফেরা উপলক্ষে নেতাকর্মীদের যাতায়াত সহজ করতে ১০টি রুটে স্পেশাল ট্রেন চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বিএনপির নির্বাচনি কাজে ব্যবহারের জন্য বুলেটপ্রুফ বাস ও বিশেষ নিরাপত্তাসম্পন্ন গাড়িও দেশে এসেছে।
সব মিলিয়ে, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি নতুন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। নির্বাচনের আগে এই প্রত্যাবর্তন রাজনীতিতে কী ধরনের মেরুকরণ, সমঝোতা বা চমক নিয়ে আসে—সেদিকেই এখন দেশবাসী ও রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি নিবদ্ধ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



