ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকা একটি ভূমিকম্পসংবেদনশীল শহর। অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস, নকশাবহির্ভূত নির্মাণ—এ সব মিলিয়ে শহরটি প্রতিনিয়ত বিপদের দিকে ছুটছে। বড় কোনো ভূমিকম্প বা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটলেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়, সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সরব হয়; কিন্তু কয়েক দিন পরই সব চাপা পড়ে যায়। ফলে বছরের পর বছর ধরে যেসব ভবন মানুষের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে আছে, সেগুলোর প্রকৃত তালিকা, যথাযথ পরিকল্পনা কিংবা ধ্বংসের কার্যকর পদক্ষেপ—কোনোটাই নেই।
এই অবস্থাকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে একাধিক সংস্থার পরস্পরবিরোধী তথ্য, অনিয়ম, অসহযোগিতা এবং মালিকদের উদাসীনতা। ফলে ঢাকার ঠিক কত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ, কতগুলো ভেঙে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং কতগুলো বাস্তবে ভাঙা হয়েছে—তার নির্ভরযোগ্য তথ্য কারো কাছেই নেই।
ঢাকায় ৭৪ শতাংশ ভবন নকশাবহির্ভূত—রাজউকের উদ্বেগ
রাজউকের সর্বশেষ পর্যালোচনা বলছে, রাজধানীতে গড়ে ওঠা ভবনগুলোর প্রায় ৭৪ শতাংশই নকশাবহির্ভূত। অর্থাৎ নির্মাণের সময় নকশা অনুমোদন নেওয়া হয়নি, অথবা অনুমোদিত নকশা থেকে ব্যাপক বিচ্যুতি ঘটেছে। এই অনিয়ম শুধু আবাসিক ভবনেই নয়, বাণিজ্যিক ভবন, মার্কেট, স্কুল-কলেজ—সবখানেই দেখা যায়।
সেফটি অ্যাওয়্যারনেস ফাউন্ডেশন আয়োজিত সাম্প্রতিক এক সেমিনারে জানানো হয়, ঢাকায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। বক্তারা জানান, গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা মানা হয়নি, সেফটি অডিট নেই, দুর্যোগ সহনশীলতার প্রস্তুতি নেই। এমন অবস্থায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে এসব ভবন মৃত্যুপুঞ্জে পরিণত হতে পারে।
স্থপতি ও নগরবিদ মো. ইকবাল হাবিব বলেন, “ঢাকার প্রায় ১৩ শতাংশ এলাকায় কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা নিষিদ্ধ। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণে সেসব স্থানেও ভবন গড়ে উঠছে। পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙা তো দূরের কথা, তার ওপর নতুন নতুন ভবন নির্মাণ হচ্ছে—ফলে বসবাসই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।”
বাদ যায়নি কোনো এলাকা—ফাটল, দুলুনি ও আতঙ্কে নগরবাসী
গত কয়েক দিনের হালকা ভূমিকম্পের পর রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় ভবনে ফাটল দেখা গেছে। ধানমণ্ডি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, বাড্ডা—সবখানেই ভবন কেঁপেছে, পলেস্তারা খসে পড়েছে, কোথাও কোথাও রেলিং পর্যন্ত ভেঙে পড়েছে।
উত্তর বাড্ডার এক বাসিন্দা তার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন,
“চাবির রিং নড়ার মতো শব্দ হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখি ঘরের আসবাবপত্র দুলতে শুরু করেছে। সবাই আতঙ্কে রাস্তা বের হয়ে আসে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর বিভিন্ন অংশেও পলেস্তারা খসে পড়েছে। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, কবি জসীমউদ্দীন হল, এ এফ রহমান হল, মোকাররম ভবন ও ফজলুল হক হলে দেয়াল ভেঙে পড়ে। পুরান ঢাকার কেপি ঘোষ স্ট্রিটে পাঁচতলা ভবন থেকে রেলিং পড়ে পথচারীরা আতঙ্কিত হয়।
নিউমার্কেট থানার ওসি এ কে এম মাহফুজুল হক বলেন,
“থানা ভবনের ৩, ৪ ও ৫ তলায় ফাটল দেখা দিয়েছে। আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি।”
সূত্রাপুর ও কলাবাগান এলাকায় দুটি ভবন হেলে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে আরমানিটোলায় একটি বহুতল ভবনের কিছু ইট ও পলেস্তারার অংশ খসে পড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। খিলগাঁওয়ে নির্মীয়মাণ ভবন থেকে ইট পড়ে পাশের বাড়ির এক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
৮০–৯০ শতাংশ ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা—ফায়ার সার্ভিসের কঠোর সতর্কতা
অগ্নিকাণ্ডের দিক থেকেও রাজধানীর অবস্থা ভয়াবহ। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ঢাকার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের পরিদর্শনে তারা ২,৬০৩টি ভবনকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। শুধু বিপণিবিতানগুলোই ৫৮টি; যার মধ্যে—
-
ঝুঁকিপূর্ণ: ৩৫টি
-
মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ: ১৪টি
-
অতিঝুঁকিপূর্ণ: ৯টি
২০২৪ সালে করা জাতীয় পর্যায়ের পরিদর্শনে দেখা যায়—
১,১৮১টি বহুতল ভবনের মধ্যে ৩৬৭টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৭৪টি অতিঝুঁকিপূর্ণ।
ফায়ার সার্ভিস ভবন মালিকদের সুপারিশ পাঠালেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উদাসীনতা প্রকট। অনেক মালিক সিঁড়ির জায়গাও দখল করে রেখেছেন, জরুরি নির্গমন পথ নেই, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পুরোনো বা অকেজো।
রাজউকের নির্দেশনা আসে, কিন্তু ভাঙা হয় খুব কম ভবন
রাজউক প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে ভাঙার নির্দেশনা দিলেও বাস্তবায়ন অত্যন্ত অল্প। গত ১০ বছরে রাজউক যতগুলো ভবন ভাঙার নোটিশ দিয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশও ভাঙা হয়নি।
উল্লেখযোগ্য ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে—
-
কবি নজরুল কলেজের ছয়তলা ভবন
-
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারটি ভবন
-
পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজের পাশের দোতলা ভবন
“আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প : রাজউক অংশ” এর মাধ্যমে ঢাকা অঞ্চলের ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩০টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়। মাউশি এসব ভবনের তালিকা প্রকাশ করে, এমনকি ভবনের সামনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ সাইনবোর্ড টানানোর নির্দেশ দেয়। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলার সুপারিশও করা হয়।
কিন্তু বাস্তবে—
-
শ্রেণিকক্ষ সংকট,
-
পাঠদান বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা,
-
কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতা—
এসব কারণ দেখিয়ে ভবনগুলো এখনও চালু রয়েছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিএমডিপি ৪৪টি সরকারি ভবনকে আরও ‘অধিক ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে ঘোষণা করে ভাঙার সুপারিশ করে কিন্তু এখনো কোনো প্রকৃত উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
রাউকের ব্যাখ্যা—নানা কারণে ভাঙা সম্ভব হয়নি
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা নিয়মিত নোটিশ দিয়েছি। নির্দেশনার পরও বিভিন্ন কারণে ভবনগুলো ভাঙা হয়নি। ভূমিকম্পের পর বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে, আগামীকাল জরুরি সভা বসছে। আশা করছি এবার সংশ্লিষ্টরা উদ্যোগী হবেন।”
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, জরুরি সভা হলেও আগের মতো সময় পেরিয়ে গেলে আবার সব শান্ত হয়ে যাবে।
ঝুঁকির মধ্যে লাখো মানুষ—তবুও পদক্ষেপ নেই
রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা হাজার হাজার। বাস্তবে এসব ভবনে বাস করছে লাখো মানুষ। ঝুঁকি জানা সত্ত্বেও অনেকেই বাসা বদলাতে পারেন না; আবার যারা চান, তারা বিকল্প বাসস্থানের অভাবে বা আর্থিক কারণে যেতে পারেন না।
নগরবিদরা বলছেন—
-
জরুরি ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের হালনাগাদ নির্ভরযোগ্য তালিকা তৈরি করা প্রয়োজন
-
ভবন মালিকের দায়িত্ব নিশ্চিত করতে কঠোর জরিমানা এবং আইন প্রয়োগ জরুরি
-
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে পুনর্নির্মাণে বিশেষ পুনর্বাসন স্কিম প্রয়োজন
-
অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা নিশ্চিত করতে বার্ষিক বাধ্যতামূলক অডিট অপরিহার্য
অন্যথায়, বড় ধরনের ভূমিকম্প বা অগ্নিকাণ্ড ঘটলে প্রাণহানির মাত্রা ভয়াবহ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।
ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংকট আজ নতুন নয়—বরং দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা, উদাসীনতা এবং নিয়ন্ত্রণহীন নগরায়ণের ফল। এখনই সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে ভবিষ্যতে যে কোনো বড় দুর্যোগ পুরো রাজধানীকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



