ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনীতি এখন সম্পূর্ণভাবে নির্বাচনকেন্দ্রিক। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত অন্তর্বর্তী সরকার, পাশাপাশি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, গণহত্যা বিচার প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান—সব মিলিয়ে রাজনীতি চরম উত্তেজনাপূর্ণ সময় পার করছে। এসব বড় ইস্যুর ভিড়ে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক বিষয়গুলো যেন আড়ালে চলে গেছে।
ফলে অর্থনীতির প্রাণশক্তি ব্যবসা ও বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে, আর এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে সরকারের রাজস্ব আদায়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এই ঘাটতির হার প্রায় ৯ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে নানা সমস্যা ছিল—ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতা, সুদের হার বৃদ্ধি, আমদানি সীমাবদ্ধতা—সব মিলিয়ে ব্যবসায়িক পরিবেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে শিল্প উৎপাদন ও নতুন বিনিয়োগ উভয়ই কমে যায়।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদরা হয়তো অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করাবেন। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাতে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেলেও অভ্যন্তরীণ ব্যবসা, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান খাতে এখনো স্থবিরতা বিরাজ করছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. সাদিক আহমেদ বলেন, “সরকারি ও বেসরকারি দুই ক্ষেত্রেই ব্যয় কমে গেছে। বিনিয়োগকারীরা এখন অপেক্ষা করছেন—রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটবে কি না, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা উন্নত হবে, জ্বালানি ও ব্যাংকিং খাত কতটা স্থিতিশীল হবে—এসব বিষয়েই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে এখনো বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সংকট আছে। ব্যবসা পরিচালনার খরচ ভিয়েতনাম বা ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমের সুফল পেতে অন্তত এক-দুই বছর লাগবে। তার পরই হয়তো রাজস্ব আদায় ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির ধারা ফিরতে পারে।”
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে—এটি আপাতদৃষ্টিতে ইতিবাচক মনে হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে গভীর সংকট। কারণ রিজার্ভ বৃদ্ধির মূল কারণ উৎপাদন ও আমদানি কমে যাওয়া।
শিল্পে নতুন বিনিয়োগ না হওয়ায় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি হ্রাস পেয়েছে। আগস্টে আমদানি কমেছে ১৬.৭১ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। বিশ্লেষকদের ভাষায়, “রিজার্ভ বাড়ছে, কিন্তু অর্থনীতি খাচ্ছে না।”
যখন শিল্পে উৎপাদন কমে, তখন কর্মসংস্থানও কমে যায়, মানুষের আয় হ্রাস পায়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় পণ্যের চাহিদা কমে, ব্যবসা স্থবির হয়। এভাবে পুরো অর্থনৈতিক চক্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে—যার ফলে রাজস্ব আদায়ও মারাত্মকভাবে কমে যায়।
রাজস্ব ঘাটতি পূরণে এনবিআর এখন মরিয়া। সংস্থাটি করফাঁকি, বকেয়া রাজস্ব ও আদালতে আটকে থাকা মামলার রাজস্ব পুনরুদ্ধারে বিশেষ অভিযান শুরু করেছে। এনবিআরের একটি শীর্ষ সূত্র জানায়, ব্যবসায়িক মন্দা অবস্থায় কর আদায়ে জোরপূর্বক চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব নয়।
সূত্রটি বলে, “একটা প্রতিষ্ঠান যদি বেঁচে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে রাজস্ব আসবে। এখন জোর করে কর আদায় করলে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে রাজস্বের দরজাই বন্ধ হবে।”
এনবিআর এখন কয়েকটি কৌশল গ্রহণ করেছে—বকেয়া কর আদায়ে মনোযোগ বৃদ্ধি, করদাতাবান্ধব সেবা চালু, হয়রানি প্রতিরোধ, সব খাতে অটোমেশন চালু, এবং আদালতে আটকে থাকা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৩৬ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৮.২৯ শতাংশ। বাসাভাড়া, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের চাপ বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের আয় বাড়ছে না।
ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে। এতে পণ্যের চাহিদা আরও কমছে, যার প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজস্ব আয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার ধরে রেখে মূল্যস্ফীতি কমানোর নীতি কার্যকর হয়নি বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিতে মন্দার সরাসরি প্রভাব পড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর। ২০২৫ সালের সাময়িক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। এটি আগের কয়েক বছরের ৬ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। বিশ্বব্যাংকও বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ বড়জোর ৪.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে।
কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, “রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের আগে অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করতে হয়। কিন্তু এখানে সেটি করা হয়নি। সিগারেট খাতের কর বৃদ্ধি না হলে রাজস্ব আদায়ের অবস্থা আরও খারাপ হতো।”
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না ফিরলে বিনিয়োগ বাড়বে না। কারণ বিনিয়োগ মানেই দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত বড় মাপের বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে কেউ রাজি নন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরএন পাল বলেন, “দেশে সামগ্রিক উৎপাদন ও ভোগ কমে গেছে। ক্রয়ক্ষমতা কমলে বিক্রি কমে, আর বিক্রি কমলে রাজস্বও কমে। ব্যাংকগুলো এখন ঋণ দিতে খুবই সতর্ক, ফলে বিনিয়োগও কমছে। এই চক্র থেকেই রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।”
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “দেশে আয় না বাড়লে ট্যাক্স আসবে কীভাবে? আইন-শৃঙ্খলা ও ব্যবসায় পরিবেশ উন্নত না হলে কেউ বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করবে না। এখন সবাই অপেক্ষা করছে নতুন রাজনৈতিক সরকারের জন্য। তখনই হয়তো ব্যবসা ও বিনিয়োগে গতি ফিরবে।”
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক জটিল চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে—ব্যবসায় মন্দা রাজস্ব কমাচ্ছে, রাজস্ব কমায় সরকারি ব্যয় সংকুচিত হচ্ছে, ব্যয় কমায় অর্থনীতি আরও মন্থর হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ভেতর এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না আসে, ততদিন পর্যন্ত বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব নয়। আর বিনিয়োগ না বাড়লে রাজস্ব ঘাটতি, প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও কর্মসংস্থানের সংকট অব্যাহতই থাকবে।
এখন সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব—অর্থনীতির এই স্থবির অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কারণ, রাজস্ব ঘাটতি শুধু হিসাবের বিষয় নয়—এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের প্রতিফলন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



