ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে—সংসদ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদ অনুযায়ী সংস্কার না করে, তবে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে। আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় কমিশন তাদের সুপারিশপত্র ও ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’-এর খসড়া প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেবে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আদেশে সাংবিধানিক সংস্কারের দুটি বিকল্প পদ্ধতি প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথমত, আগামী সংসদে গঠিত ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ (Constitution Reform Council) ৯ মাস বা ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বাধ্য থাকবে। দ্বিতীয়ত, যদি পরিষদ এই সময়সীমার মধ্যে সংস্কার শেষ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে জুলাই সনদে বর্ণিত সংস্কারসমূহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিশনের সমাপনী বৈঠকে এই খসড়া ও সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজসহ কমিশনের শীর্ষ সদস্যরা। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে—এই বৈঠকের মধ্য দিয়েই কমিশনের আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সরকার গণভোটের আগেই জুলাই সনদের আলোকে সংবিধান সংশোধনের খসড়া বিল প্রস্তুত করবে। গণভোটে এই আদেশ অনুমোদিত হলে পরিষদ ৯ মাসের মধ্যে সংশোধন সম্পন্ন না করলে, বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংসদে পাস হয়েছে বলে গণ্য হবে।
১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে মোট ৮৪টি সংস্কার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি বিষয়ে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দিয়েছে, বিশেষত উচ্চকক্ষ গঠনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR) পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও প্রধানমন্ত্রীর পদে মেয়াদসীমা নিয়ে।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, খসড়া আদেশে বলা হয়েছে—যেসব সংস্কারে সর্বসম্মতি বা ঐকমত্য আছে, সেগুলো হুবহু বাস্তবায়ন করবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ। তবে যেসব সিদ্ধান্তে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলো পরিষদ আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণ বা বাতিল করতে পারবে।
সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয় উচ্চকক্ষ বা দ্বিতীয় কক্ষ গঠন। বিএনপি এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করছে, তবে জামায়াত, এনসিপি ও কয়েকটি ক্ষুদ্র দল অন্তত উচ্চকক্ষের জন্য PR পদ্ধতি সমর্থন করছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে পরিষদে PR পদ্ধতি নিয়ে ভোট হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে উচ্চকক্ষ গঠন প্রক্রিয়া ৯ মাসের মধ্যেই শুরু হবে। প্রথমবারের নির্বাচনে উচ্চকক্ষের জন্য প্রার্থী তালিকা আগেভাগে দিতে হবে না। তবে পরবর্তী নির্বাচন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আগেই ১০০ প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করতে হবে।
তবে কমিশন সূত্র জানিয়েছে, আদেশে এই বিষয়ে একটি ‘বিশেষ শর্ত’ যুক্ত করা হচ্ছে—গণভোটে অনুমোদন পেলে পরিষদ বাধ্যতামূলকভাবে উচ্চকক্ষ গঠনের অনুমোদন দেবে।
খসড়া অনুযায়ী, ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ নিজেই হবে সংবিধান সংস্কারের মূল দলিল, তবে গণভোট হবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ’-এর ওপর।
গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে, আগামী সংসদ হবে দ্বৈত-ভূমিকাযুক্ত—অর্থাৎ সংসদ ও সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে।
-
স্পিকার হবেন পরিষদের সভাপতি।
-
সংসদ তার স্বাভাবিক কাজ (বাজেট, আইন, প্রশাসন) চালাবে।
-
পরিষদ জুলাই সনদের ভিত্তিতে সাংবিধানিক পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংযোজন করবে।
গণভোটের মাধ্যমে পরিষদকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষমতা (Constituent Power) প্রদান করা হবে, যা একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বৈঠকে কমিশন প্রস্তাব করে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান থেকে উদ্ভূত ক্ষমতাবলে আদেশটি জারি করা হবে। বিএনপি এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে; তাদের মতে, বিদ্যমান আইনের আওতায় প্রজ্ঞাপন জারি করেই নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজন সম্ভব। কিন্তু জামায়াত ও এনসিপি বলেছে, সনদকে সাংবিধানিক মর্যাদা দিতে আইনি ভিত্তিসহ আদেশ জারি করা জরুরি।
কমিশনের একাধিক সদস্য জানান, প্রধান উপদেষ্টাকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে—অভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে জারি করা আদেশই হবে আইনি ভিত্তি। গণভোটে জনগণকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করা হবে:
“আপনি কি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ সমর্থন করেন?”
ভোটাররা “হ্যাঁ” বা “না” ভোটের মাধ্যমে মতামত দেবেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এই প্রস্তাবে সিদ্ধান্তমূলক সম্মতি জানিয়েছেন বলে কমিশন সূত্র জানিয়েছে।
কমিশন জানিয়েছে, গণভোটে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত অন্তর্ভুক্ত থাকবে না। পুরো সনদই পাঠানো হবে পরিষদে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে—প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর নির্ধারণে ঐকমত্য রয়েছে, তবে ‘একাধিক পদে থাকা যাবে না’—এই বিষয়ে ভিন্নমত আছে। পরিষদে এ নিয়ে ভোট হলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।
সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুরে কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হবে, এরপর সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানানো হবে।
তিনি বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের কাজ ছিল সংস্কারের একটি ভিত্তি তৈরি করা। আমরা সেই লক্ষ্য পূরণ করেছি। মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় অংশ নিয়েছে—এটাই আমাদের জন্য বড় অর্জন।”
কমিশনের সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। সংস্কারের ধারাবাহিকতা ভেঙে গেলে জনগণের আস্থা নষ্ট হবে।”
অন্যদিকে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “সনদ বাস্তবায়নে সরকারকে দৃঢ়তা, নিষ্ঠা ও সাহস প্রদর্শন করতে হবে। এই সুযোগ হারানো মানে গণতন্ত্রের আরেকটি দীর্ঘ অবসান।”
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানান, “শহীদ পরিবারগুলো বলছে—সংস্কার নিশ্চিত না হলে তাদের সন্তানদের আত্মত্যাগ বৃথা যাবে। তাই সরকারের দায়িত্ব এখন এটি কার্যকর করা।”
বৈঠকের শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্দেশ দেন, কমিশনের সব নথি, অডিও, ভিডিও ও ছবি রাষ্ট্রীয় আর্কাইভে সংরক্ষণ করতে। তিনি বলেন, “এগুলো জাতির মূল্যবান সম্পদ—যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে, আমরা কীভাবে ও কোন প্রেক্ষাপটে এই ঐকমত্যে পৌঁছেছি।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কমিশনের এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এটি হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ—যেখানে জনগণের সরাসরি অনুমোদন ও স্বয়ংক্রিয় সংস্কারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



