ছবি: সংগৃহীত
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাঠামো, ক্ষমতা ও এখতিয়ার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সরকার প্রণয়ন করছে এক যুগান্তকারী অধ্যাদেশ—দুদক অধ্যাদেশ ২০২৫। বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই অধ্যাদেশের খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। খসড়াটিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তনটি আনা হয়েছে তা হলো—এখন থেকে বিচারক, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করতে দুদকের আর সরকারের পূর্বানুমতি লাগবে না।
দীর্ঘদিন ধরে দুদকের স্বাধীনতা নিয়ে যে বিতর্ক ও সমালোচনা চলছিল, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তার অবসান ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দুদক আইনের ৩২(ক) ধারা, যা ২০১৩ সালে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যুক্ত হয়েছিল, সেটিতেই বলা ছিল—বিচারক বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার আগে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারা অনুযায়ী সরকারের অনুমতি নিতে হবে। অর্থাৎ, অনুমতি ছাড়া কোনো আদালত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করতে পারবে না।
এই বিধানটি কার্যত দুদকের স্বাধীনতাকে সীমিত করে দিয়েছিল। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলেই কমিশনকে সরকারের অনুমতির অপেক্ষা করতে হতো, যা অনেক সময় দীর্ঘসূত্রতায় পরিণত হতো। ফলে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুই করা যেত না।
খসড়া অধ্যাদেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ৩২(ক) ধারা বাতিল করা হবে। ফলে দুদক এখন থেকে নিজস্ব তদন্ত ও প্রমাণের ভিত্তিতে যে কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে—সেই ব্যক্তি সরকারি কর্মকর্তা, বিচারক বা রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত কেউ হোক না কেন।
এই সিদ্ধান্তকে বাংলাদেশের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের একটি বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, দুর্নীতিবিরোধী কর্মীরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
২০১৪ সালে উচ্চ আদালতও ৩২(ক) ধারাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে মন্তব্য করেছিলেন যে, “এটি আইনের শাসনের পরিপন্থী এবং দুদকের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে।” কিন্তু আদালতের রায়ের পরও ধারা বাতিল করা হয়নি—শুধু কার্যত অকার্যকর অবস্থায় রাখা হয়েছিল।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেন, “যদি সরকার সত্যিই ৩২(ক) ধারা বাতিল করে, তাহলে এটি দুর্নীতি দমনে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে। এতদিন এই ধারার কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা থেমে গিয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন, “যদিও আদালতের রায়ের পর থেকেই এটি কার্যত অকার্যকর ছিল, কিন্তু আইনে থেকে যাওয়ায় প্রশাসনিকভাবে দুদক অনেক সময় বিব্রত অবস্থায় পড়ত। এখন অন্তত সেই বাধা দূর হবে।”
খসড়া অধ্যাদেশটি মূলত দুদক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে প্রণয়ন করা হয়েছে। কমিশনের এই প্রতিবেদন ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩২(ক) ধারা ছিল ‘বৈষম্যমূলক’, যা সরকারি কর্মকর্তাদের এক ধরনের আইনি সুরক্ষা দিত, কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য ছিল না। এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের প্রতি আইনি পক্ষপাত সৃষ্টি হয়, যা গণতন্ত্র ও সুশাসনের পরিপন্থী।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছিল—দুদককে সত্যিকারের স্বাধীনতা দিতে হলে সরকারি অনুমতির বাধা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং আমলাতান্ত্রিক প্রভাব—এই তিনটি বিষয় দূর করতে হবে।
অধ্যাদেশের খসড়ায় শুধু মামলা সংক্রান্ত বিধানই নয়, কমিশনের গঠন ও কার্যপ্রণালীতেও বড় পরিবর্তনের প্রস্তাব আনা হয়েছে।
প্রথমত, কমিশনারদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো—দুদকের নেতৃত্বে নিয়মিত রদবদলের মাধ্যমে জবাবদিহি ও গতিশীলতা নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, কমিশনের তিনজন সদস্যের মধ্যে অন্তত একজন নারী কমিশনার থাকার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এই ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে।
তৃতীয়ত, নির্বাচনী কমিটি এখন সাত সদস্যের হবে, যা আগে ছিল পাঁচ সদস্য। নতুন কমিটির নেতৃত্ব দেবেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি।
কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হবেন:
-
প্রধান বিচারপতি মনোনীত একজন নারী বিচারক,
-
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি),
-
সরকারি বা বিচার কমিশনের চেয়ারম্যান,
-
স্পিকারের মনোনীত একজন করে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্য,
-
এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত একজন সুশাসন বা দুর্নীতিবিরোধী বিশেষজ্ঞ, যাঁর অন্তত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকবে।
সংসদ বিলুপ্ত হলে কমিটি থেকে সংসদ সদস্যদের বাদ দেওয়া হবে।
খসড়া অনুযায়ী, কমিশন গঠনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী, জীবনবৃত্তান্ত ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। এমনকি কমিটি নিজ উদ্যোগেও যোগ্য প্রার্থী খুঁজে সাক্ষাৎকার নিতে পারবে।
যোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে যাঁদের বিদেশে স্থায়ী নাগরিকত্ব, বসবাসের অনুমতি বা অনুমোদনহীন বিনিয়োগ আছে, তাঁরা অযোগ্য বলে গণ্য হবেন।
তবে সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান খসড়া নিয়ে কিছু হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “খসড়াটি সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক হলেও কিছু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ বাদ পড়েছে।”
তার মতে, কমিশনের কার্যক্রমে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘সিলেকশন অ্যান্ড রিভিউ কমিটি’ গঠনের প্রস্তাব ছিল, যা বাদ দেওয়া হয়েছে। শর্টলিস্ট করা প্রার্থীদের নাম প্রকাশের প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয়েছে।
“আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কমিশনের কর্মদক্ষতা প্রতি ছয় মাসে একবার মূল্যায়ন করতে হবে, কিন্তু সেটিও রাখা হয়নি,” বলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এই নির্বাহী পরিচালক।
তিনি আরও যোগ করেন, “কমিশনারের সংখ্যা তিন থেকে পাঁচে বাড়ানোর প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়নি। সরকারের এই মনোভাব সংস্কারবিরোধী এবং রাজনৈতিকভাবে হতাশাজনক।”
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, যেখানে দুদকের জেলা কার্যালয় থাকবে, সেখানে বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করা হবে। অর্থাৎ, অভিযোগ যাচাই, তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়া একই জেলার মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে, যা দুর্নীতির মামলার গতি বাড়াবে।
এছাড়া, দুদকের এখতিয়ার বাড়িয়ে বলা হয়েছে—দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের দুর্নীতির পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের দুর্নীতি-সংক্রান্ত কার্যক্রমও দুদকের আওতায় আসবে।
‘জ্ঞাত আয়’ বলতে এখন থেকে শুধু বৈধ আয়ের উৎসকে বোঝানো হবে—যা প্রমাণযোগ্য। এভাবে দুদকের মামলা দায়ের, অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষমতা আরও বিস্তৃত করা হয়েছে।
দুদকের সংস্কারকে বিশ্লেষকরা বলছেন—বাংলাদেশের দুর্নীতি দমনে সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক সংস্কার। কারণ এতদিন সরকারি অনুমতির বাধা দুদকের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
এই পরিবর্তনের মাধ্যমে কমিশন প্রথমবারের মতো স্বাধীনভাবে মামলা দায়ের ও তদন্ত করতে পারবে, যা দেশে আইনের শাসন ও প্রশাসনিক জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় নতুন অধ্যায় খুলবে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন—শুধু আইন পরিবর্তন করলেই হবে না; কমিশনের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বাধীনতা, মানবসম্পদ সক্ষমতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাও জরুরি।
যেমনটা ড. ইফতেখারুজ্জামান বললেন, “আইন যত ভালোই হোক, যদি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে কোনো পরিবর্তনই টেকসই হয় না।”
দুদক অধ্যাদেশ ২০২৫ শুধু একটি আইনি পরিবর্তন নয়—এটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কারের ইতিহাসে এক মাইলফলক হতে পারে।
যদি এই অধ্যাদেশ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির যুগের অবসান ঘটবে। দুর্নীতি দমন কমিশন আবারও প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক এবং জনগণের আস্থাভাজন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারে—যা একটি স্বচ্ছ, ন্যায়নিষ্ঠ ও সুশাসনভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



