ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অভ্যন্তরে সংঘবদ্ধ একটি চক্র জাল ভিসায় মানবপাচার, যাত্রীদের লাগেজ কেটে চুরি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে বদলি বাণিজ্য ও অনৈতিক সুবিধাদি প্রদানের মতো ভয়াবহ অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে বিমানের দু'জন কর্মী সরাসরি এ সকল কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসার পর বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এই ঘটনায় দেশের বিমানবন্দর নিরাপত্তা ও বিমান কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ে তৈরি হয়েছে গভীর উদ্বেগ।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন: যা উঠে এসেছে
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জুনিয়র গ্রাউন্ড সার্ভিস অফিসার মিজানুর রহমান শিশির ও তৎকালীন চেকিং স্টাফ কৃষ্ণ সুধার নেতৃত্বে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়। তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অভিযোগগুলো হলো:
-
জাল ভিসা ও বডি কন্ট্রাক্টে মানবপাচার: ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে জাল ভিসা (বিশেষত স্টাডি ভিসা) প্রাপ্ত বা ভিজিট ভিসার আড়ালে ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের অভিযোগ। ২৬ অক্টোবর জাল স্টাডি ভিসা ধারী এক যাত্রীকে যুক্তরাজ্যে পাঠানোর চেষ্টাকালে তিনি আটক হন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে ওই যাত্রীর বডি কন্ট্রাক্ট করা হয়েছিল।
-
লাগেজ কাটিং চক্র: যাত্রীদের লাগেজ বিমানে তোলার পর নির্দিষ্ট গন্তব্যে না পৌঁছে দেওয়া বা লাগেজ কেটে চুরি করার একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সঙ্গেও শিশির ও তার সহযোগীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
-
রাজনৈতিক প্রভাব ও বদলি বাণিজ্য: বিমান শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা ব্যবহার করে শিশির নিয়মিত দায়িত্ব পালন না করলেও প্রভাব খাটিয়ে বদলি বাণিজ্য, সহকর্মীদের হয়রানি ও অনৈতিক সুবিধা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯ সালে সৈয়দপুর বদলির শাস্তি এড়িয়ে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের তদবিরে সিলেট বদলি হন তিনি।
-
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সহযোগিতা: গোয়েন্দা তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীকে দেশত্যাগে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে শিশিরের বিরুদ্ধে।
-
অবৈধ ট্রাভেল এজেন্সি: শিশির তার স্ত্রীর মাধ্যমে সিলেটের এয়ারপোর্ট রোডে 'আবরার টেলিকম' নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সি অবৈধভাবে পরিচালনা করতেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
কীভাবে কাজ করত চক্রটি?
গোয়েন্দা ও অভ্যন্তরীণ সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চক্রটির কার্যপদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ:
১. লক্ষ্য নির্ধারণ: যারা বৈধ ভিসা ছাড়াই বিদেশে পাড়ি জমাতে চান, বিশেষ করে যাদের ইংরেজি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা কম, তাদের টার্গেট করা হতো।
২. বডি কন্ট্রাক্ট: লক্ষ্যপূরণে জাল ভিসা প্রস্তুত করা হতো বা ভিজিট ভিসার সুযোগ নেওয়া হতো। এরপর নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে 'বডি কন্ট্রাক্ট' করা হতো, যা নিশ্চিত করত বিমানবন্দর পর্যন্ত যাত্রীর নির্বিঘ্ন পৌঁছানো।
৩. অভ্যন্তরীণ যোগসাজশ: বিমানের অভ্যন্তরীণ কর্মী (চেকিং স্টাফ) কৃষ্ণ সুধার মতো ব্যক্তিরা টিকিট ও বোর্ডিং পাস ইস্যু এবং ইমিগ্রেশন কার্ডে অনিয়মিততা এড়াতে সাহায্য করতেন। অভিযোগ রয়েছে, শিশির ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে কৃষ্ণ সুধাকে কাঙ্ক্ষিত পোস্টিং করিয়েছিলেন।
৪. অভিগমন কৌশল: জাল ভিসা নিয়ে গন্তব্য দেশে পৌঁছানোর পর অনেক যাত্রী সরাসরি ইমিগ্রেশনে না গিয়ে বিমানবন্দরের 'অ্যাসাইলাম ডেস্কে' গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করতেন, যেখানে ভিসার বৈধতা ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
৫. লাগেজ চুরির মডাস অপারেন্ডি: লাগেজ চুরির ক্ষেত্রে, সম্ভবত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বা কার্গো বিভাগের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে লাগেজটি গন্তব্যে না পাঠিয়ে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হতো।
মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থান ও তদন্ত নির্দেশ
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন পেয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় দ্রুত行动 নেয়। গত ২৫ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মাহফুজা জেরিন স্বাক্ষরিত একটি চিঠি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাফিকুর রহমানের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে অভিযোগগুলোর গভীর তদন্ত করে প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিমান কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের চিঠি গ্রহণ করেছে এবং অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্টদের বর্তমান অবস্থা
সূত্রমতে, অভিযুক্ত মিজানুর রহমান শিশির বর্তমানে বিমানের যশোর স্টেশনে কর্মরত রয়েছেন। অন্যদিকে, সহযোগী কৃষ্ণ সুধাকে 'গ্রাউন্ডেড' বা ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দু'জনের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য: নিরাপত্তা ও সুনামে মারাত্মক ঝুঁকি
এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. মোহাম্মদ আলী আশরাফ বলেন, "রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থার অভ্যন্তরে এ ধরনের একটি চক্রের সক্রিয় থাকার তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি শুধু বিমানসংস্থার সুনামের জন্য নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক হুমকি। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের বিমানবন্দর ও বিমান সংস্থাগুলোর অভ্যন্তরীণ তদারকি ও জবাবদিহিতা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁক রয়েছে, যা দ্রুত বন্ধ করতে হবে।"
আন্তর্জাতিক অভিবাসন নীতি বিশেষজ্ঞ ড. সৈয়দা রোকেয়া সুলতানা বলেন, "বডি কন্ট্রাক্ট বা জাল ভিসা পাচারের এই পদ্ধতি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই দেখা যায়। কিন্তু যখন একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার কর্মীরাই এতে জড়িত থাকেন, তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে শুধু পাচারই নয়, অন্যান্য সংগঠিত অপরাধও পরিচালনার সুযোগ তৈরি হয়। জোরালো অভ্যন্তরীণ তদন্তের পাশাপাশি এই ঘটনায় আন্তঃদেশীয় তথ্য বিনিময় ও সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ।"
এভিয়েশন ল অ্যান্ড সেফটি এক্সপার্ট ব্যারিস্টার ফারহানা আহমেদ তার মন্তব্যে বলেন, "বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আইসিএও (ICAO) এবং আইএটিএ (IATA)-এর সদস্য। এর মানে তাদের আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা প্রোটোকল মেনে চলা বাধ্যতামূলক। এ ধরনের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বিমান কর্তৃপক্ষের নজরে এলে বিমান বাংলাদেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, এমনকি নির্দিষ্ট রুটে ফ্লাইটে বিধিনিষেধও আসতে পারে। তাই একটি স্বচ্ছ, সময়োপযোগী ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত অত্যন্ত জরুরি।"
বিমান কর্তৃপক্ষ কি বলছে?
বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) বোসরা ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, "মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত চিঠির বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সাথে নিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে প্রক্রিয়া চলমান। ফাইল উত্থাপন করা হয়েছে, আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। কমিটির তদন্তে প্রাথমিক সত্যতা প্রমাণিত হলে বিভাগীয় মামলা ও আইনগত সব ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হবে।"
মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা ও গণমাধ্যম ও জনমনে তৈরি হওয়া চাপের পরিপ্রেক্ষিতে এবার অপেক্ষা করতে হবে বিমান কর্তৃপক্ষের তদন্ত প্রতিবেদনের। সংশ্লিষ্ট সকল অভিযোগের সত্যতা যাচাই, জড়িত অন্যান্য ব্যক্তি শনাক্তকরণ এবং এই চক্রের সঙ্গে বিমান বা বিমানবন্দরের অন্যান্য বিভাগের কোনো সংযোগ ছিল কিনা, তা নিশ্চিত করাই হবে এই তদন্তের মুখ্য বিষয়। পাশাপাশি, বিমানবন্দর নিরাপত্তা জোরদার এবং অভ্যন্তরীণ নজরদারি বাড়ানোর দাবিও উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। দেশের প্রধান ও একমাত্র রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থার সুনাম ও নিরাপত্তা এই তদন্তের সুষ্ঠু ও নিষ্পক্ষ সমাপ্তির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



