
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে মেধা পাচার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রতিভাবান শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে প্রায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, যা জাতীয় উন্নয়ন ও মানবসম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। গত দুই দশকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর গড়ে অর্ধ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাচ্ছে। তাদের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের অন্তত ৫৭টি দেশ।
মেধা পাচারের আকার ও পরিসংখ্যান
বিদেশে শিক্ষার্থীদের পাঠানোর ব্যয় প্রতি বছরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষাগ্রহণ শেষে উন্নত কর্মসংস্থান ও নিরাপদ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষায় প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্থায়ীভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন। এভাবে বাংলাদেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তৈরি করা মেধাবীরা বিদেশের জন্য কাজ করছেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উদাহরণটি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রতি ব্যাচের ৪০–৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদেশে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে ভিড় করছেন।
ফরেন এডুকেশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্টস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ফ্যাড-ক্যাব) কর্মকর্তারা এবং শিক্ষাবিদরা বলছেন, মেধা পাচারের পেছনে রয়েছে শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়নের অভাব। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থী দেশে সুযোগ পান না, যখন কম যোগ্য কেউ রাজনৈতিক প্রভাব বা ঘুষের মাধ্যমে সুবিধা পেয়ে যায়।
বিদেশে শিক্ষার্থীর গন্তব্য ও বৃদ্ধি
এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত গুণ বেড়েছে। ২০১১-২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৩,৩১৪ জন শিক্ষার্থী ছিলেন, যা ২০২৩-২৪ সালে বেড়ে ১৭,০৯৯ জনে পৌঁছেছে। ‘ওপেন ডোরস ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ডাটা’ অনুসারে, এক বছরের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির হার বেড়েছে ২৬ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
ইউনেসকো ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে ৫২,৭৯৯ জন শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে ৫৫টি দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছেন। ২০০৫ সালে বিদেশে গিয়েছিলেন ১৫,০০০ শিক্ষার্থী। ২০ বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
সরকারি ব্যয় ও ক্ষতি
বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বুয়েটের একটি ব্যাচের একজন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীর পেছনে সরকার কমপক্ষে ১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। সরকারি মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে এই খরচ ১৫ লাখ টাকারও বেশি। অর্থাৎ দেশের জনগণের দেওয়া করের টাকায় এই শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করছেন।
একজন শিক্ষার্থী তানিয়া আহমেদ সুইডেনে বৃত্তি নিয়ে চলে যান। তিনি আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন, কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে শিক্ষক নিয়োগে তার সুযোগ হয়নি। বর্তমানে তিনি সুইডেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সুইডিশ নাগরিক।
মেধা পাচারের কারণ
-
চাকরির নিম্ন বেতন
-
অনুন্নত কর্মপরিবেশ
-
দক্ষতা যথাযথ কাজে লাগানোর সুযোগ না থাকা
-
রাজনৈতিক অস্থিরতা
-
মেধাবী শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়নের অভাব
ফ্যাড-ক্যাবের কর্মকর্তা সেলিম রায়হান বলেন, “যেখানে মেধাবীর মূল্যায়ন নেই, সেখানে তারা বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য প্রলোভনে চলে যায়। এটি দেশের মানবসম্পদ হারানোয়ের প্রধান কারণ।”
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন (সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী) বলেন, “মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠানো উচিত, তবে একটি ‘ট্যালেন্ট পুল’ গঠন করতে হবে। পড়াশোনার খরচ সরকার বহন করবে এবং শিক্ষার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এই ব্যবস্থা রিভার্স ব্রেন ড্রেনের মূল কাঠামো।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, “চীন ও ভারতের মতো উদ্যোগ নেওয়া উচিত। তারা বিদেশে পড়ানো শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে এনে দেশে ব্যবহার করে। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। দেশে মেধাবী প্রজন্মের যথাযথ মূল্যায়ন না করা হলে তারা বিদেশে স্থায়ীভাবে চলে যায়।”
যুব সমাজের মনোভাব
‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ জরিপ অনুযায়ী, ১৮–৩৫ বছর বয়সিদের ৫৫ শতাংশ বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, তরুণ প্রজন্ম দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তাদের সঠিক পরিচর্যা ও মূল্যায়নের অভাবে দেশের ভবিষ্যত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
দেশের ক্ষতি
মেধাবীরা বিদেশে গেলে দেশ বড় তিন ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে:
-
জাতি তাদের সেবায় বঞ্চিত হয়।
-
তারা দেশে কোনো অর্থ পাঠায় না।
-
তাদের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি দুর্নীতিবাজরা বিদেশে অর্থ পাচার করেন।
বাংলাদেশে মেধা পাচার ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ ও কর্মসংস্থানের আগ্রহ বাড়লেও দেশে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন ও সুযোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ট্যালেন্ট পুল’ এবং রিভার্স ব্রেন ড্রেনের মতো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া না হলে দেশ দীর্ঘমেয়াদে মানবসম্পদ ও জাতীয় উন্নয়নে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ