
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকা—যেখানে যানজট যেন নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। অফিসের পথে কিংবা ফিরতি সন্ধ্যায় কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেগে যেত। কিন্তু হঠাৎই বদলে গেছে সেই চিত্র। নতুন করে চালু হওয়া স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সাতটি মোড়ে এনে দিয়েছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর থেকে শুরু করে বিমানবন্দরগামী রাস্তায় এখন দেখা যাচ্ছে শৃঙ্খলিত যান চলাচল, আর যানজটের দুর্ভোগও অনেকটা কমেছে।
সময়ের সঙ্গে পাল্টানো রাজধানীর সিগন্যাল চিত্র
রাজধানীর ব্যস্ততম বিজয় সরণি মোড়—যেখানে প্রতিদিন হাজারো গাড়ি আটকে থাকত। একসময় এই মোড়ে দাঁড়িয়ে চালকদের সময় কাটত ১৫ থেকে ২০ মিনিট। কিন্তু এখন চিত্রটা একেবারে ভিন্ন। মিরপুর থেকে ফার্মগেটগামী একটি প্রাইভেটকারের চালক জানালেন— “নতুন সিগন্যাল বাতিতে টাইমার দেখেই বোঝা যায় কখন ছাড়বে। দুই থেকে তিন মিনিট অপেক্ষা করলেই সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে, আর গাড়িগুলো সহজেই পার হতে পারে। এখন আর আগের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় না।”
নতুন সিগন্যাল বাতিগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো—প্রতিটি সিগন্যালে ডিজিটাল কাউন্টডাউন ডিসপ্লে রয়েছে, যা চালক ও পথচারী উভয়কেই অপেক্ষার সময় সম্পর্কে আগেভাগে জানিয়ে দেয়।
যানজট নিয়ন্ত্রণে দেশীয় প্রযুক্তির নতুন যুগ
ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রণে এবার ব্যবহার হচ্ছে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা, যার নকশা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
প্রকল্পের আওতায় হাইকোর্ট (মৎস্য ভবন মোড়) থেকে শুরু করে শাহবাগ-বিজয় সরণি হয়ে বিমানবন্দর পর্যন্ত ২২টি মোড়ে সিগন্যাল বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি মোড়ে সিগন্যাল স্থাপন ও পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয়েছে, যেগুলো হলো—
ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল মোড়, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, অ্যাভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় গেটসংলগ্ন ইউটার্ন ও জাহাঙ্গীর গেট মোড়।
প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বিত উদ্যোগ
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে একাধিক সরকারি সংস্থা—
-
নেতৃত্ব দিচ্ছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)
-
বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন
-
কার্যকর প্রয়োগের দায়িত্ব পালন করছে ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ
সিগন্যালগুলো স্থাপনে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টাকা। সব যন্ত্রাংশ তৈরি ও স্থাপন কাজ দেশীয়ভাবে সম্পন্ন হয়েছে—যা এক নতুন সাফল্য বলেই মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা।
পুলিশ বলছে—শৃঙ্খলা আসছে ধীরে ধীরে
কারওয়ান বাজারে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা শফিউল আলম জানান, “স্বয়ংক্রিয় টাইমার সিস্টেম চালুর পর থেকে যানবাহন আর আগের মতো আটকে থাকে না। আমরা এখন চালকদের সহায়তা করছি যাতে সবাই নতুন সিগন্যাল ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে পারেন। কিছুদিনের মধ্যেই এর সুফল পুরোপুরি বোঝা যাবে।”
তিনি আরও বলেন, আগে যেখানে একজন ট্রাফিক পুলিশকে হাতের ইশারায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হতো, এখন ডিজিটাল সিগন্যালই সেটি করছে। ফলে মানবিক ভুল বা বিলম্বের সুযোগ কমে গেছে।
চালকদের অভিজ্ঞতা—“এখন আর ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থাকতে হয় না”
দেওয়ান পরিবহনের বাসচালক বারেক মিয়া বলেন, “আগে বিজয় সরণি সিগন্যালে ২০ মিনিট বসে থাকতে হতো, এখন লাগে দুই থেকে তিন মিনিট। কারওয়ান বাজারেও একই অবস্থা ছিল, এখন সেখানেও জ্যাম নেই। এটা বড় স্বস্তি।”
সিএনজি চালক বাচ্চু মোল্লা বলেন, “আগে মহাখালী থেকে বিজয় সরণি পর্যন্ত গাড়ির লাইন লেগে থাকত। এখন টাইমার আছে, তিন মিনিট পর সিগন্যাল ছাড়ে। যাত্রীও খুশি, আমরা চালকরাও খুশি। এমন সিগন্যাল সারা শহরে দেওয়া উচিত।”
তথ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত সিগন্যাল সাইকেল
বুয়েটের পরিবহন প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, “আমরা গত কয়েক মাস ধরে যানবাহনের ঘনত্ব, পিক ও অফ-পিক আওয়ারে চলাচলের গতি—সবকিছু বিশ্লেষণ করেছি। সেই তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিটি মোড়ের জন্য আলাদা ‘সিগন্যাল সাইকেল টাইম’ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়সীমা দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে পরিবর্তন হয়।”
তিনি বলেন, এই ডিজিটাল সিগন্যালগুলো শুধু যানবাহনের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণই করছে না, বরং পথচারীদের নিরাপদ পারাপারেরও সুযোগ তৈরি করছে। “দুই থেকে তিন মিনিট পরপর নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হচ্ছে শুধুমাত্র পথচারীদের পারাপারের জন্য। এটি দুর্ঘটনা কমাতে বড় ভূমিকা রাখবে।”
নগর বিশেষজ্ঞদের মত—“স্মার্ট ট্রাফিক ব্যবস্থার দিকে বড় পদক্ষেপ”
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, “ঢাকার যানজটের মূল সমস্যা ছিল—মানবিক সিদ্ধান্তনির্ভর সিগন্যাল ব্যবস্থা। এখন সেটি ডিজিটাল হচ্ছে। এটি একটি স্মার্ট ও তথ্যনির্ভর নগর ট্রাফিক ব্যবস্থার সূচনা।”
তিনি আরও বলেন, “তবে এই ব্যবস্থার সফলতা নির্ভর করবে এর রক্ষণাবেক্ষণ, জনগণের সচেতনতা এবং আইন প্রয়োগের ওপর। সিগন্যাল না মানলে বা টাইমারের সঙ্গে অসচেতন আচরণ করলে পুরো ব্যবস্থার সুফল নষ্ট হয়ে যাবে।”
নগর পরিকল্পনাবিদ আর্কিটেক্ট ইকবাল হাবিব বলেন, “স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ঢাকার মতো বিশৃঙ্খল নগরে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু এটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে ট্রাফিক পুলিশ, ডিটিসিএ, সিটি কর্পোরেশন এবং বুয়েটকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
পরিকল্পনাবিদদের প্রস্তাব—‘স্মার্ট সিটি কানেক্ট’
বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব করেছেন, ভবিষ্যতে এই সিগন্যাল ব্যবস্থাকে একটি কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যুক্ত করে রিয়েল-টাইম মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা উচিত। এতে এক ক্লিকেই জানা যাবে কোন মোড়ে যানজট বাড়ছে, কোথায় সিগন্যাল বিকল, কোথায় রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য—“চালক-পথচারীর সচেতনতা জরুরি”
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আক্তার বলেন, “আমরা চাই সিগন্যালগুলো যেন সঠিকভাবে কাজ করে, কিন্তু সেটি নির্ভর করছে চালক ও পথচারীর আচরণের ওপর। সচেতনতা বাড়লে এই ব্যবস্থা পুরোপুরি সফল হবে।”
তিনি জানান, বাকি ১৫টি মোড়েও ধীরে ধীরে এই সিস্টেম স্থাপন করা হবে। সবগুলো সিগন্যাল চালু হলে রাজধানীর যানজট ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রাজীব খাদেম বলেন, “বুয়েটের সহায়তায় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এসব যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। আমরা প্রতিদিনই এর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করছি। ধীরে ধীরে পুরো নগর এই স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের আওতায় আসবে।”
নতুন স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা এখন ঢাকার রাস্তায় এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। যেখানে আগে গাড়ির সারি লেগে থাকত কিলোমিটারের পর কিলোমিটার, এখন সেই জায়গায় চলছে গতি, শৃঙ্খলা ও পূর্বাভাসনির্ভর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।
নগরবাসীর আশা—এই পরীক্ষামূলক উদ্যোগ টিকে থাকুক এবং বিস্তৃত হোক পুরো ঢাকা জুড়ে, যাতে রাজধানী একদিন সত্যিকার অর্থে ‘স্মার্ট সিটি ঢাকা’-তে রূপ নিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ