
ছবি: সংগৃহীত
দেহ ও মনকে চাঙ্গা, ভারমুক্ত ও কর্মক্ষম রাখতে নিয়মিত শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের বিকল্প নেই। তবু অনেকেই বিশেষ করে বয়স্ক মানুষরা ব্যায়াম নিয়ে নানা ভুল ধারণায় ভোগেন। কেউ মনে করেন, বয়স বাড়লে ব্যায়াম করলে ক্ষতি হয়, কেউ ভাবেন এতে আঘাত লাগে, আবার কেউ মনে করেন শরীরচর্চা করা মানে ব্যয়বহুল জিমে যাওয়া। এই ভুল ধারণাগুলো কেবল ভুল নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বিপজ্জনক, কারণ নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন শারীরিক ও মানসিক নানা জটিলতা তৈরি করে। আজকের আলোচনায় থাকছে বয়স্কদের ব্যায়াম নিয়ে ছয়টি প্রচলিত ভুল ধারণা ও তার বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা।
১. “আমি তো অনেক বুড়ো হয়ে গেছি, এখন ব্যায়াম করে লাভ কী?”
এই ধারণা সবচেয়ে বড় ভুল। বয়স যাই হোক, শরীরচর্চা শুরু করার জন্য কখনোই দেরি নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা গবেষণায় প্রমাণিত, নিয়মিত ব্যায়াম করলে বয়সজনিত দুর্বলতা, পেশির ক্ষয়, হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া, এবং হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই হ্রাস পায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ৬০ বছর পার করা মানুষেরাও যদি নিয়মিতভাবে হালকা হাঁটা, সাঁতার, যোগব্যায়াম বা এরোবিক ব্যায়াম করেন, তাহলে তাদের হৃদ্রোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৪০–৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের (AHA) পরামর্শ—সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন, দিনে ৩০ মিনিট করে হাঁটা বা হালকা কার্ডিও ব্যায়াম করা উচিত।
অর্থাৎ, বয়স কোনো বাধা নয়; বরং বুড়ো বয়সে ব্যায়ামই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। ধীরে শুরু করুন, কিন্তু নিয়মিত চালিয়ে যান।
২. “ব্যায়াম করলে আঘাত পাব, তাই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়”
অনেকে মনে করেন, বয়স্ক অবস্থায় ব্যায়াম করলে পড়ে গিয়ে আঘাত লাগতে পারে। বাস্তবতা হলো, নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরের ভারসাম্য, পেশিশক্তি ও হাড়ের দৃঢ়তা বেড়ে যায়—ফলে আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি বরং কমে।
বিশেষ করে ব্যালান্স এক্সারসাইজ যেমন যোগব্যায়াম, তাই চি (Tai Chi), অথবা স্ট্রেচিং ব্যায়াম শরীরের নমনীয়তা বাড়ায়, ফলে হঠাৎ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমে।
তবে যেকোনো ব্যায়াম শুরু করার আগে অভিজ্ঞ ট্রেইনার বা ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তারা শরীরের উপযোগী ব্যায়ামের ধরন নির্ধারণ করে দিতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সঠিক ভঙ্গিতে করা ব্যায়াম কখনোই ক্ষতিকর নয়।
৩. “আমার হার্ট দুর্বল, ব্যায়াম করলে বিপদ হতে পারে”
এটিও এক ভয়াবহ ভুল ধারণা। বরং হৃদ্রোগীদের জন্য নিয়মিত ও হালকা ব্যায়াম হচ্ছে জীবনের রক্ষাকবচ। প্রতিদিন মাত্র ২০ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটলে রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে, যা হৃদ্রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।
অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ব্যায়াম শুরু করা জরুরি। ভারী ব্যায়াম যেমন জগিং বা ভারোত্তোলন না করলেও চলে—হালকা হাঁটা, সিঁড়ি ওঠানামা বা হালকা সাইক্লিং হৃদপিণ্ডকে সক্রিয় রাখে এবং হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়ায়।
চিকিৎসকদের মতে, শ্বাস নিতে কষ্ট না হলে এবং মাথা ঘোরা বা বুকে চাপ না থাকলে প্রতিদিনের হাঁটা ও স্ট্রেচিং হার্টের জন্য নিরাপদ ও উপকারী।
৪. “ব্যায়াম করতে গেলে অনেক খরচ—জিমে ভর্তি হতে হবে”
ব্যায়াম মানেই জিমে যাওয়া—এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ব্যায়ামের সবচেয়ে বড় খরচ হলো নিজের সময় ও ইচ্ছাশক্তি।
ঘরে বসেই করা যায় অনেক কার্যকর ব্যায়াম। উদাহরণস্বরূপ—
প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা,
সিঁড়ি ওঠানামা,
টিনের কৌটা বা পানির বোতল দিয়ে হালকা ওয়েট ট্রেনিং,
বাগান করা বা ঘরের কাজ—সবই শরীরচর্চার অংশ।
শুধু একটি আরামদায়ক জুতা থাকলেই আপনি হাঁটতে বের হতে পারেন। চাইলে অনলাইনে বিনামূল্যের ভিডিও দেখে সহজ যোগব্যায়াম শেখাও সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে কার্যকর ব্যায়াম সেইটা—যেটা আপনি নিয়মিত করতে পারেন, না যে ব্যায়ামটা সবচেয়ে দামি।
৫. “আগের মতো শক্তি নেই, তাই ব্যায়াম করার মানে নেই”
বয়স বাড়লে শারীরিক শক্তি কিছুটা কমে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সেটাই ব্যায়াম না করার কারণ হতে পারে না। বরং ব্যায়ামের মূল উদ্দেশ্য হলো দেহ ও মনকে সক্রিয় রাখা, দ্রুততা নয়।
তরুণ বয়সে আপনি হয়তো ৫ কিলোমিটার দৌড়াতে পারতেন, এখন হয়তো ১ কিলোমিটার হাঁটাই চ্যালেঞ্জ মনে হয়—তবুও সেটি মূল্যবান ব্যায়াম। কারণ নিয়মিত চলাফেরা আপনার রক্তসঞ্চালন, পেশির স্থিতিস্থাপকতা ও মানসিক স্থিরতা বজায় রাখে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বয়সজনিত বিষণ্নতা বা একাকীত্ব দূর করতেও নিয়মিত ব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকর। এতে শরীরে এন্ডোরফিন নামক ‘হ্যাপিনেস হরমোন’ তৈরি হয়, যা মন ভালো রাখে এবং ঘুমের মান উন্নত করে।
৬. “ব্যায়াম করার সঙ্গী নেই, একা করতে পারব না”
বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন, ব্যায়াম করতে হলে সঙ্গী বা গ্রুপ দরকার। যদিও সত্য হলো, একা করেও শরীরচর্চা করা যায় এবং তাতেও সমান উপকার পাওয়া সম্ভব।
তবে সামাজিকভাবে উৎসাহ বাড়ানোর জন্য শুরুতে পরিবারের সদস্য, বন্ধু বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে হাঁটা শুরু করা যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ব্যায়ামের অগ্রগতি শেয়ার করলে অনেকেই অনুপ্রাণিত হন।
সবচেয়ে বড় কথা, নিজের সুস্থতার দায়িত্ব নিজের। আপনি একাই শুরু করুন—শুরুটাই সবচেয়ে কঠিন ধাপ। একবার নিয়ম তৈরি হলে এটি জীবনযাপনের অংশ হয়ে যাবে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরচর্চার প্রয়োজন আরও বেড়ে যায়। ব্যায়াম শুধু শরীরের জন্য নয়, মন, মস্তিষ্ক ও আবেগের ভারসাম্যের জন্যও অপরিহার্য। তাই বয়স বা ভয়কে কারণ বানিয়ে বসে না থেকে নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিদিন কিছুটা সময় দিন শরীরচর্চায়।
শুরু করুন ধীরে ধীরে—হয়তো হাঁটা দিয়ে, হয়তো যোগব্যায়াম দিয়ে। কিন্তু থামবেন না। কারণ, বয়স নয়, নিয়মিত ব্যায়ামই আপনাকে রাখবে প্রাণবন্ত, ফিট ও সুখী।
বাংলাবার্তা/এমএইচ