
ছবি: সংগৃহীত
করদাতাদের জন্য বড় সুখবর দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এবার থেকে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি সেবা পেতে আর আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র লাগবে না—শুধু কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সনদই যথেষ্ট হবে। এই উদ্যোগ কার্যকর হয়েছে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে। এনবিআর বলছে, করদাতাদের জন্য প্রক্রিয়া সহজ করা এবং নতুন করদাতা যুক্ত করা এই নীতির মূল লক্ষ্য।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লাইসেন্স, নিবন্ধন বা সদস্যপদ নিতে হলে কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দিতে হতো। কিন্তু অনেক নতুন উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীর নিয়মিত রিটার্ন দেওয়ার অভ্যাস এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে তারা প্রাথমিক পর্যায়ে সেবা নিতে ভোগান্তির মুখে পড়তেন। এনবিআরের মতে, টিআইএন সনদ থাকা মানেই ওই ব্যক্তি কর নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছেন। তাই প্রাথমিক স্তরে শুধু টিআইএন সনদ দেখানোর সুযোগ দিলে করদাতাদের সংখ্যা ও অংশগ্রহণ বাড়বে।
এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, "অনেক সময় দেখা যায়, কেউ সদ্য ব্যবসা শুরু করেছেন বা নতুন কোনো পেশায় যুক্ত হয়েছেন। তারা এখনো আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছাননি। কিন্তু তাদের ব্যবসা পরিচালনা বা পেশাগত নিবন্ধনের জন্য রিটার্ন চাওয়া হয়, যা অযৌক্তিক। এই জটিলতা দূর করতে আমরা টিআইএন সনদকেই প্রাথমিক যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে গ্রহণ করছি।"
এনবিআর সূত্র জানায়, টিআইএন সনদ এখন সম্পূর্ণ ডিজিটালভাবে ইস্যু করা হয়। অনলাইনে নিবন্ধনের পর করদাতা একটি সিস্টেম জেনারেটেড প্রত্যয়নপত্র পান, যেখানে নাম, টিআইএন নম্বর, ঠিকানা ও ইস্যুর তারিখ উল্লেখ থাকে। এই সনদ যেকোনো সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে গ্রহণযোগ্য হবে, যদি এটি এনবিআরের ওয়েবসাইট বা অনলাইন সিস্টেম থেকে যাচাইযোগ্য হয়।
যে ১২টি সেবায় রিটার্ন ছাড়াই চলবে টিআইএন
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিচের ১২টি সেবা পেতে আয়কর রিটার্নের প্রমাণপত্র লাগবে না—
১. ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ:
সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় নতুন ব্যবসা শুরু করতে উদ্যোক্তাদের শুধু টিআইএন সনদ দিলেই হবে। রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র আর বাধ্যতামূলক নয়।
২. সমবায় সমিতি নিবন্ধন:
নতুন সমবায় গঠন বা নিবন্ধনের সময় শুধুমাত্র টিআইএন সনদ জমা দিলেই হবে। এটি স্থানীয় সমবায় দপ্তরে প্রযোজ্য হবে।
৩. বিমা সার্ভেয়ারের লাইসেন্স:
সাধারণ বিমা কোম্পানির অনুমোদিত সার্ভেয়ার হতে আবেদন করলে কেবল টিআইএন সনদ দেখালেই চলবে। রিটার্ন দাখিলের প্রয়োজন নেই।
৪. ক্রেডিট কার্ড গ্রহণ ও নবায়ন:
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নতুন ক্রেডিট কার্ড নিতে বা নবায়ন করতে রিটার্ন নয়, টিআইএন দেখানোই যথেষ্ট। এটি বিশেষ করে নতুন চাকরিজীবী ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধাজনক।
৫. পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ:
চিকিৎসক, আইনজীবী, হিসাববিদ, প্রকৌশলী, স্থপতি বা সার্ভেয়ারসহ বিভিন্ন স্বীকৃত পেশায় সদস্য হতে টিআইএন সনদই চলবে, রিটার্ন লাগবে না।
৬. পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব:
পাঁচ লাখ টাকার বেশি অঙ্কে ডাকঘরে সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ লাগবে না। শুধু টিআইএন সনদ দিলেই খাতা খোলা যাবে।
৭. সরকারি বেতন-ভাতা গ্রহণ:
মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) বা সরকারি বেতন কাঠামোয় দশম গ্রেড বা তার ঊর্ধ্বের কর্মচারীদের বেতন পেতে টিআইএন সনদই যথেষ্ট হবে।
৮. মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন থেকে আয়:
বিকাশ, নগদ, রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কমিশন বা ফি আয়ের ক্ষেত্রে রিটার্নের প্রমাণ না দেখিয়েও কেবল টিআইএন দেখিয়ে লেনদেন বৈধ করা যাবে।
৯. দলিল লেখক ও স্ট্যাম্প বিক্রেতার লাইসেন্স:
স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি বা কার্টিজ পেপার ভেন্ডর এবং দলিল লেখক হিসেবে নিবন্ধনের সময় টিআইএন দেখালেই হবে, রিটার্ন লাগবে না।
১০. অটোরিকশা বা ত্রিচক্রযান নিবন্ধন:
ত্রিচক্র মোটরযান (যেমন অটোরিকশা, ইজিবাইক) নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নের সময় টিআইএন সনদই যথেষ্ট হবে।
১১. ই-কমার্স ব্যবসার লাইসেন্স:
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নতুন ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করতে এখন শুধু টিআইএন সনদ দেখালেই লাইসেন্স পাওয়া যাবে।
১২. প্রাতিষ্ঠানিক নিবন্ধন বা গঠন:
কোনো কোম্পানি, ট্রাস্ট বা সমিতি গঠনের বছর বা তার পরের বছরে নিবন্ধনের সময় রিটার্নের বদলে টিআইএন সনদ দিলেই হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের কর সংস্কৃতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। বর্তমানে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ হলেও, রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৩৫ লাখের মতো ব্যক্তি। এই ব্যবধান কমাতে রিটার্নবিহীন প্রাথমিক সেবা চালুর সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ট্যাক্স পলিসি রিসার্চ ফোরামের নির্বাহী পরিচালক ড. আবু হানিফ বলেন, “অনেক নাগরিক টিআইএন নিতে চান, কিন্তু রিটার্ন না দিতে পারার ভয়ে নিবন্ধন এড়িয়ে যান। এখন সেই মানসিক বাধা দূর হবে। ফলে কর ব্যবস্থার আওতা দ্রুত বাড়বে।”
এনবিআর জানিয়েছে, ভবিষ্যতে আরও কিছু সেবায় এই সুবিধা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, নারী ব্যবসায়ী, ফ্রিল্যান্সার এবং নতুন নিবন্ধিত স্টার্টআপগুলোর জন্য রিটার্ন-নির্ভর শর্ত শিথিল করা হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কর সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চাই ভয় বা জটিলতা নয়, বরং সহযোগিতা ও ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তাই টিআইএনধারীদের প্রাথমিক সেবায় অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।”
এই উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশে করদাতার সংখ্যা এবং রাজস্ব উভয়ই বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, রিটার্ন ছাড়াই টিআইএন ভিত্তিক সেবা চালু করা হচ্ছে কর ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তরের দিকে এক বড় পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ