
ছবি: সংগৃহীত
এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার এবারের ফলাফল বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক কঠিন বাস্তবতা সামনে এনেছে। দীর্ঘ দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম পাসের হার এবং জিপিএ ৫ প্রাপ্তির ব্যাপক পতন প্রমাণ করছে—শিক্ষাঙ্গনে চলমান অস্থিরতা, শিক্ষক সংকট ও শেখার ঘাটতির যৌথ প্রতিফলনই এবারের ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরারের ভাষায়, “আমরা একটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছি—এই ফলাফলে আমরা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছি, যা আনন্দের নয়, উদ্বেগের।”
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮.৮৩ শতাংশ। এই হার ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন, যখন পাসের হার ছিল ৪৭.৭৪ শতাংশ। এবার ১১টি শিক্ষা বোর্ডে মোট ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৬১ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়, যার মধ্যে পাস করেছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৯৬০ জন। অর্থাৎ প্রায় পাঁচ লাখ আট হাজার শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে।
গত বছরের তুলনায় পাসের হার কমেছে প্রায় ১৮.৯৫ শতাংশ এবং জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭৬ হাজার ৮১৪ জন কম। এ বছর জিপিএ ৫ পেয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ জন, যেখানে গত বছর এই সংখ্যা ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বছরজুড়ে শিক্ষাঙ্গনে চলা অস্থিরতা, আন্দোলন ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা এবারের ফলাফলে বড় প্রভাব ফেলেছে। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত সারাদেশের স্কুল-কলেজে ক্লাস ব্যাহত হয়েছে, অনেক জায়গায় নিয়মিত পাঠদান বন্ধ থেকেছে।
উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাও রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অংশ ছিল। সরকার পরিবর্তনের পরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিক একাডেমিক পরিবেশ ফিরতে দেরি হয়েছে। অনেক জায়গায় শিক্ষক লাঞ্ছনা, আন্দোলন, প্রশাসনিক স্থবিরতা এবং শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া কেন্দ্রিক কর্মসূচির কারণে পাঠদানের ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “আমাদের শিক্ষাঙ্গন গত এক বছর ধরে স্থিতিশীল ছিল না। করোনার পর শিক্ষাব্যবস্থায় যেই দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল, তা কখনো পূরণ করা যায়নি। এখন আবার শিক্ষকদের আন্দোলন, কম বেতন এবং অব্যবস্থাপনার ফলে শেখার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই পাঁচ লাখ অকৃতকার্যের দায় আমরা সবাইকেই নিতে হবে।”
এবার খাতা মূল্যায়নে কোনো সহানুভূতি নম্বর বা নমনীয় মূল্যায়ন দেওয়া হয়নি বলে বোর্ড সূত্রে জানা গেছে। শিক্ষা বোর্ডগুলো জানিয়েছে, শিক্ষার্থীরা যা পেয়েছে, তাই দেওয়া হয়েছে—অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া হয়নি। এ কারণে ফলাফল বাস্তব শেখার স্তরকে প্রতিফলিত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশীদ বলেন, “আগের সময়ে পাসের হারই সাফল্যের মানদণ্ড ছিল। সরকার চাইত পাসের হার বাড়ুক, শিক্ষার্থীরা খুশি থাকুক, তাই নম্বরেও কিছুটা সহানুভূতি থাকত। কিন্তু এবার বাস্তব মূল্যায়ন করা হয়েছে। এটা ভালো দিক, যদিও ফলাফল হতাশাজনক। এখন আমাদের শেখার ঘাটতির মূল জায়গা শনাক্ত করতে হবে।”
এ বছর ৯ হাজার ৩০২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু এর মধ্যে ২০২টি প্রতিষ্ঠান থেকে একজনও পাস করেনি। গত বছর এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬৫। অন্যদিকে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠান কমে দাঁড়িয়েছে ৩৪৫টিতে, যা গত বছর ছিল ১,৩৩৮।
শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, এর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সারা দেশে শিক্ষার মানে অসমতা চরম আকার ধারণ করেছে। রাজধানী ও বড় শহরের কলেজগুলোতে তুলনামূলক ভালো ফল হলেও, উপজেলা ও গ্রামীণ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়াবহভাবে পিছিয়ে পড়েছে।
আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এবারও মেয়েরা ফলাফলে ছেলেদের ছাড়িয়ে গেছে। মেয়েদের পাসের হার ৬২.৯৭ শতাংশ, আর ছেলেদের ৫৪.৬০ শতাংশ। জিপিএ ৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৪৪ জন মেয়ে, যেখানে ছেলে পেয়েছে ৩২ হাজার ৫৩ জন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, মেয়েদের নিয়মিত উপস্থিতি, পাঠ্যক্রমে যত্নশীলতা ও পরিবারিক সহায়তার কারণে তারা তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকছে। তবে ছেলেদের মধ্যে অনিয়মিত উপস্থিতি, মোবাইল গেম ও সামাজিক অস্থিরতায় মনোযোগ বিচ্যুতি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
এ বছর সবচেয়ে বেশি পাসের হার দেখা গেছে মাদরাসা বোর্ডে—৭৫.৬১ শতাংশ। তবে জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে আছে ঢাকা বোর্ড, যেখানে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২৬ হাজার ৬৩ জন।
অন্যদিকে সবচেয়ে কম পাসের হার কুমিল্লা বোর্ডে, মাত্র ৪৮.৮৬ শতাংশ।
বোর্ডভিত্তিক সংক্ষিপ্ত চিত্র—
রাজশাহী বোর্ড: পাস ৫৯.৪০%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ১০,১৩৭ জন।
যশোর বোর্ড: পাস ৫০.২০%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫,৯৯৫ জন।
চট্টগ্রাম বোর্ড: পাস ৫২.৫৭%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৬,০৯৭ জন।
বরিশাল বোর্ড: পাস ৬২.৫৭%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ১,৬৭৪ জন।
সিলেট বোর্ড: পাস ৫১.৮৬%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ১,৬০২ জন।
দিনাজপুর বোর্ড: পাস ৫৭.৪৯%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ৬,২৬০ জন।
ময়মনসিংহ বোর্ড: পাস ৫১.৫৪%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ২,৬৮৪ জন।
কারিগরি বোর্ড: পাস ৬২.৬৭%, জিপিএ ৫ পেয়েছে ১,৬১০ জন।
ইংরেজি ও আইসিটিতে বিপর্যয়
বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি খারাপ করেছে ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে। ইংরেজিতে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৩.৬৬%, কিন্তু যশোর বোর্ডে তা নেমে এসেছে ৫৪.৮২%-এ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইংরেজি শেখায় দুর্বলতা নতুন নয়। বিদ্যালয় পর্যায়ে প্রশিক্ষিত ইংরেজি শিক্ষক ঘাটতি, শ্রেণিকক্ষে ভাষা-অনুশীলনের পরিবেশের অভাব এবং পরীক্ষামুখী শিক্ষা পদ্ধতি এই বিষয়টিতে দীর্ঘমেয়াদে দুর্বলতা তৈরি করেছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেন, “আমরা অনেক বছর ধরে পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর সংখ্যা বাড়ানোকে সফলতা হিসেবে দেখেছি। কিন্তু শেখার প্রকৃত মান যাচাইয়ের চেষ্টা করিনি। এখন বাস্তব চিত্রটা সামনে এসেছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শেখার ঘাটতি তৈরি হয়েছে, যা বছরের পর বছর জমে এইচএসসি পর্যায়ে এসে বড় আকার নিয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ফলাফলকে আমরা ব্যর্থতা হিসেবে নয়, বরং আত্মসমালোচনার সুযোগ হিসেবে নিচ্ছি। প্রতিটি শিক্ষা বোর্ডকে তাদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি বিশদ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা হচ্ছে, যারা শেখার মূল ঘাটতিগুলো শনাক্ত করবে এবং ভবিষ্যতের করণীয় নির্ধারণ করবে।”
আন্ত শিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন,
“আমরা কোনো বোর্ডকে নির্দেশ দিইনি যে নম্বর বাড়িয়ে দিতে হবে বা ওভারমার্কিং করতে হবে। এবার খাতা মূল্যায়নে কঠোরতা ছিল, তাই বাস্তব ফল এসেছে। প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাস না করা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক, কিন্তু এটি শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করছে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “এখনই সময় সঠিক জায়গায় হাত দেওয়ার। গলদ আছে—সেটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এই গলদই আমাদের পরবর্তী সংস্কারের সুযোগ এনে দিয়েছে।”
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল শিক্ষাব্যবস্থার গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, শিক্ষক আন্দোলন, শেখার ঘাটতি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা মিলে ফলাফলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ পতন। মেয়েরা তুলনামূলক ভালো করলেও সামগ্রিক শিক্ষার মান স্পষ্টভাবে নিম্নমুখী। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই যদি শিক্ষা খাতে কাঠামোগত সংস্কার শুরু না করা হয়, ভবিষ্যতে এই সংকট আরও গভীর হবে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য এ ফলাফল কেবল সংখ্যাগত পতন নয়—এটি এক জাগরণের ঘণ্টাধ্বনি, যা মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষা শুধু পরীক্ষার ফল নয়, বরং শেখার সংস্কৃতি ও মানবসম্পদের বিনিয়োগ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ