
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অভূতপূর্ব এক আর্থিক পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকটে জর্জরিত পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে গঠন করা হচ্ছে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ইসলামী ব্যাংক। এই একীভূতকরণে ব্যাংকগুলোর কোটি কোটি টাকার দায়-দেনা, সম্পদ, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আমানতসমূহ নতুন ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবে। তবে ব্যক্তিগত আমানতকারীদের টাকাগুলো ফেরত পেতে সময় লাগবে সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত—এমনটাই উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রণীত রোডম্যাপে।
সরকার অনুমোদিত এই একীভূত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—
১. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (FSIBL),
২. ইউনিয়ন ব্যাংক,
৩. গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক,
৪. সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (SIBL),
৫. এক্সিম ব্যাংক।
এই পাঁচ ব্যাংকই গত কয়েক বছর ধরে তারল্য সংকট, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপির কারণে ব্যাপক সমস্যায় ছিল। ২০২৪ সালের শুরুতে আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মগুলোর করা ফরেনসিক অডিটে দেখা যায়, এসব ব্যাংকের ৯০ শতাংশেরও বেশি ঋণ অ-প্রদর্শনযোগ্য (NPL)—যা কার্যত দেউলিয়া অবস্থার প্রতিচ্ছবি।
অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট ঋণের ৯৬.৩৭ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৭.৮ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৬২.৩ শতাংশ এবং এক্সিম ব্যাংকের ৪৮.২ শতাংশ খেলাপি বা পুনরুদ্ধার-অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এ পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত আমানত বর্তমানে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই বিপুল অঙ্কের দায় এখন নতুন ব্যাংকের কাঁধে এসে পড়বে।
উপদেষ্টা পরিষদ গত ৯ অক্টোবর এই একীভূতকরণের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিয়েছে। নতুন ব্যাংকের জন্য দুটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে—
-
‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’, অথবা
-
‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড’।
এই ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন ধরা হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকবে। প্রাথমিক মূলধন পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার প্রতিষ্ঠানিক আমানত বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইক্যুইটিতে রূপান্তরিত হতে পারে। অর্থাৎ, বড় অঙ্কের আমানত সরাসরি ব্যাংকের শেয়ার মূলধনে রূপ নেবে।
সরকার এ ব্যাংকে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন সহায়তা প্রদান করবে—যার অর্ধেক (১০ হাজার কোটি টাকা) নগদ এবং বাকি অংশ শরিয়াহসম্মত সুকুক বন্ডের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বিস্তারিত ‘অর্থ ফেরতের রোডম্যাপ’ তৈরি করেছে, যা শিগগিরই সরকারি গেজেটে প্রকাশ করা হবে।
রোডম্যাপে বলা হয়েছে—
-
২ লাখ টাকার মধ্যে থাকা সঞ্চয়কে ‘সুরক্ষিত আমানত’ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং একীভূতকরণের পরপরই তা ফেরত দেওয়া হবে।
-
গেজেট কার্যকর হওয়ার পর যেকোনো সময় এই অঙ্কের টাকা উত্তোলন করা যাবে।
এর বাইরে থাকা বড় অঙ্কের আমানত ধাপে ধাপে ফেরত দেওয়া হবে—
-
প্রথম ছয় মাস থেকে ২৪ মাসের মধ্যে প্রতি কিস্তিতে ১ লাখ টাকা করে ছয় কিস্তিতে ফেরত দেওয়া হবে।
-
২৪ মাস পর অবশিষ্ট টাকা যেকোনো সময় উত্তোলনযোগ্য হবে।
তিন মাস বা তার বেশি মেয়াদের আমানতের ক্ষেত্রেও একইভাবে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকবে। তবে মেয়াদি আমানতের ক্ষেত্রে নতুন করে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে—
আমানতের ধরন | নতুন নিয়ম |
---|---|
৩ মাস মেয়াদি আমানত | ৩ বার স্বয়ংক্রিয় নবায়নের পর উত্তোলনযোগ্য |
৬ মাস মেয়াদি আমানত | ২ বার নবায়নের পর পরিশোধযোগ্য |
১ বছর মেয়াদি আমানত | ২ বার নবায়নের পর উত্তোলনযোগ্য |
২ বছর মেয়াদি আমানত | ৩ বছরে রূপান্তরিত হবে |
৩ বছর মেয়াদি আমানত | ৪ বছরে রূপান্তরিত হবে |
৪ বছর মেয়াদি আমানত | ৫ বছরে রূপান্তরিত হবে |
৫ বছর বা তার বেশি | মেয়াদপূর্তির সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধযোগ্য |
এ ছাড়া ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক আমানতকারী এবং ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এই মেয়াদ প্রযোজ্য হবে না; তারা চাইলে অবিলম্বে অর্থ তুলতে পারবেন।
নতুন ব্যাংকে থাকা আমানতের উপর বাজারভিত্তিক মুনাফা (Profit Rate) কার্যকর থাকবে। আমানতকারীরা তাদের বাকি ব্যালেন্সের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ বা ঋণ সুবিধা (Murabaha Facility) হিসেবে নিতে পারবেন।
ব্যাংক, সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং বড় করপোরেট আমানতকারীদের জন্য নতুন ব্যাংকে অগ্রাধিকার শেয়ার (Preference Share) ইস্যু করা হবে। এই শেয়ারগুলো পাঁচ বছর পর্যন্ত রাখতে হবে, এরপর তা মেয়াদি আমানতে রূপান্তরিত হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি ফান্ড এ স্কিমের বাইরে থাকবে।
একীভূত পাঁচ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিষয়েও খসড়া সার্কুলারে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে।
-
যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ নেই, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নতুন ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবেন।
-
তাদের চাকরির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, অর্থাৎ পূর্ববর্তী চাকরি বাতিল হবে না।
-
নতুন ব্যাংকের বোর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে পদ পুনর্নির্ধারণ বা পুনর্গঠন করতে পারবে।
-
যারা থাকতে চান না, তারা পদত্যাগ করতে পারবেন এবং সব আইনানুগ সুবিধা পাবেন।
-
প্রতারণায় দোষী প্রমাণিত কর্মকর্তাদের কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই বরখাস্ত করা যাবে।
নতুন ইসলামী ব্যাংকের বোর্ডে থাকবে নয়জন পরিচালক—
-
৫ জন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগপ্রাপ্ত,
-
৪ জন প্রধান শেয়ারহোল্ডারদের মনোনীত।
পরিচালকরা এক বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। প্রাথমিকভাবে নতুন ব্যাংকের মালিকানা থাকবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে, অর্থাৎ এটি হবে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন বছরের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদার (Strategic Investor) আনা হবে, এবং পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যাংকটি পুরোপুরি বেসরকারিকরণ করা হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই একীভূতকরণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, তবে এটি আসলে একটি ‘বেইল-ইন রিকভারি মডেল’—যেখানে গ্রাহকের অগ্রিম আমানতও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসলামি ব্যাংকিং খাতের প্রতি মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার করাই এখন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, গত এক দশকে এই ব্যাংকগুলো ইসলামি নীতির নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজনৈতিকভাবে বিতরণ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. ফারুক হোসেন বলেন, “গ্রাহকের টাকা ফেরতের জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে—এটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থার জন্য বড় ধাক্কা। তবে সরকার যদি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বচ্ছভাবে একীভূত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, তাহলে ভবিষ্যতে এই খাত স্থিতিশীল হতে পারে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এই রোডম্যাপ কার্যকর হলে দেশের আর্থিক খাত থেকে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার তারল্য সংকট দূর হতে পারে, কারণ সরকার এবং প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা নতুন ব্যাংকের মূলধনে সরাসরি অর্থ যোগান দেবে।
একীভূত ইসলামী ব্যাংক গঠন সরকারের জন্য যেমন একটি আর্থিক পুনর্বাসন কর্মসূচি, তেমনি এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি পরীক্ষাও বটে। পাঁচটি ব্যাংকের ব্যর্থতা এখন এক নতুন প্রতিষ্ঠানের কাঁধে এসে পড়েছে—যেখানে হাজার হাজার গ্রাহক তাদের জীবনের সঞ্চয় নিয়ে অপেক্ষা করছেন দীর্ঘ ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত।
এই সময়সীমা শুধু অর্থ ফেরতের নয়—বরং বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের প্রতি হারানো জনআস্থা পুনর্গঠনের সময়সীমাও।
বাংলাবার্তা/এমএইচ