
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সর্বশেষ মূল্যায়নে উঠে এসেছে একটি মিশ্র চিত্র—একদিকে প্রবৃদ্ধি সামান্য বাড়ার ইঙ্গিত, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ও চলতি হিসাবে ঘাটতির ঝুঁকি বাড়ছে। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে আইএমএফের প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক, অক্টোবর ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। তবে এই হার এখনও সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে থাকবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি সামান্য বাড়লেও অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এখনও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। আইএমএফ বলছে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, এবং ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা দেশের সামগ্রিক উৎপাদন ও বিনিয়োগ কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে।
তবে সংস্থাটি আশাবাদী যে ২০২৯-৩০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে প্রবৃদ্ধির ধারা ধীরে ধীরে ইতিবাচক দিকে অগ্রসর হবে, যদি অর্থনৈতিক নীতি সংস্কার, মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়।
প্রতিবেদন বলছে, মূল্যস্ফীতির হার এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে দেশে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল—যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ হার। এরপর থেকে কিছুটা কমলেও এটি স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
২০২৪ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার কমে ৮ দশমিক ২৯ শতাংশে নেমেছিল, কিন্তু সেপ্টেম্বরে আবার বেড়ে ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। আইএমএফের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন, এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা এই মূল্যস্ফীতির ওঠানামার প্রধান কারণ।
সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশের মুদ্রানীতি যদি আরও শিথিল থাকে, তাহলে আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির হার আবারও বাড়তে পারে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে এবং বিনিয়োগ খরচও বৃদ্ধি পাবে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লেও এর সঙ্গে সঙ্গে আমদানি ব্যয়ও বাড়বে, যা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। এতে সরকারের ডলার আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হয়ে যাবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি (Current Account Deficit) আরও বৃদ্ধি পাবে।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি জিডিপির ৪ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল, যা ছিল এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। পরবর্তী দুই অর্থবছরে ঘাটতি কমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির ১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসে। তবে আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, নতুন অর্থবছরে ঘাটতি আবারও বাড়তে পারে, কারণ আমদানি কার্যক্রম পুনরায় সক্রিয় হবে, বিশেষ করে শিল্পোন্নয়ন, জ্বালানি আমদানি, এবং ভোক্তা পণ্যে।
সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ উভয়েরই হিসাব অনুযায়ী, বাস্তব প্রবৃদ্ধি এর চেয়ে কম হবে। এর অন্যতম কারণ হলো—দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতা, রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্যহীনতা, এবং মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে হলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, ভর্তুকি নির্ভর খরচ কমানো এবং রাজস্ব আহরণে দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। একই সঙ্গে ডলার সংকট নিরসনে রেমিট্যান্স প্রবাহের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানির নতুন খাত যেমন আইসিটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে জোর দিতে হবে।
আইএমএফ তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন একটি “সামঞ্জস্যহীন কিন্তু সম্ভাবনাময়” অবস্থায় আছে। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, সরকার যদি সময়মতো নীতিগত সংস্কার ও কাঠামোগত সমন্বয় করতে পারে, তাহলে মধ্যমেয়াদে প্রবৃদ্ধি আবারও ৬ শতাংশের উপরে যেতে পারে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা এখনও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় কম। কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশের কিছু বেশি, যা সরকারি বিনিয়োগ ব্যয় ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে আইএমএফ সুপারিশ করেছে—রাজস্ব প্রশাসনে আধুনিকায়ন, কর জাল সম্প্রসারণ, এবং কাস্টমস-ভ্যাট সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করার।
আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদনটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্রও তুলে ধরে। সংস্থাটি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির গড় প্রবৃদ্ধি ২০২৫ সালে ২ দশমিক ৯ শতাংশে থাকবে—যা পূর্বাভাসের তুলনায় সামান্য কম। উন্নত দেশগুলোতে মুদ্রানীতি কঠোর হওয়ায় বিনিয়োগ কমছে, আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উচ্চ ঋণ ও আমদানি ব্যয়ের কারণে আর্থিক চাপ বাড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এখন কঠিন ভারসাম্য রক্ষার চ্যালেঞ্জে পড়েছে—একদিকে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
যদিও স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক চাপ বিদ্যমান, তবুও আইএমএফ আশাবাদ ব্যক্ত করেছে যে সঠিক নীতিমালা ও প্রশাসনিক সংস্কার বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ আবারও দ্রুত প্রবৃদ্ধির পথে ফিরতে পারবে। সংস্থাটি বিশেষভাবে সুপারিশ করেছে—
-
বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা,
-
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি,
-
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, এবং
-
রপ্তানি ও শ্রমবাজার বৈচিত্র্য বাড়ানো।
এসব পদক্ষেপ কার্যকর হলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ন পুনরুদ্ধার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, এবং স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সব মিলিয়ে, আইএমএফের নতুন পূর্বাভাস বাংলাদেশের অর্থনীতির সামনে একদিকে চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে আশার বার্তা বয়ে এনেছে। একদিকে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বাড়ছে, কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি নতুন চাপ তৈরি করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় কাজ হলো—রাজস্ব বাড়ানো, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা, এবং উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতির ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করা।
বাংলাদেশের জন্য এটাই এখন সময়—অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি নীতিগত শৃঙ্খলা বজায় রাখার।
যদি এই লক্ষ্য অর্জন করা যায়, তবে ২০২৯-৩০ অর্থবছরের মধ্যে ৬.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের আইএমএফের পূর্বাভাস বাস্তবে রূপ নিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ