
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রশাসনে ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রাজস্ব আহরণে গতিশীলতা আনা, কর জাল সম্প্রসারণ, এবং সরকারি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে সরকার এনবিআরের আওতায় নতুন ১২টি কমিশনারেট, কাস্টমস হাউস এবং বিশেষায়িত দপ্তর গঠন করেছে। পাশাপাশি এসব নতুন ইউনিটে কর্মপরিধি ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াতে মোট ৩ হাজার ৫৯৭টি নতুন পদ সৃজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল আমিন শেখ এক সরকারি বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) ইতোমধ্যে নতুন দপ্তর সৃষ্টির আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে দেশের কাস্টমস ও ভ্যাট ব্যবস্থাপনা আরও বিকেন্দ্রীভূত, সেবাবান্ধব এবং প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠবে।
সরকারি আদেশ অনুযায়ী, পুনর্গঠন প্রক্রিয়াটি তিন ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম ধাপে ৫টি নতুন মূল্য সংযোজন কর কমিশনারেট গঠন করা হবে, যা মূলত ব্যবসায়িক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলভিত্তিক এলাকায় কর প্রশাসন জোরদার করবে। দ্বিতীয় ধাপে ৪টি নতুন কাস্টমস হাউস স্থাপন করা হবে, যার মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৃতীয় ধাপে ৩টি বিশেষায়িত ইউনিট গঠন করা হবে, যেগুলো মূলত গোয়েন্দা কার্যক্রম, ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক মানের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন নিয়ে কাজ করবে।
এই নতুন কাঠামোর আওতায় ৩ হাজার ৫৯৭টি নতুন পদ সৃষ্টির অনুমোদন পেয়েছে এনবিআর। এর মধ্যে ৩৭৩টি ক্যাডার পদ (যেখানে বিসিএস কাস্টমস ও এক্সাইজ সার্ভিসের কর্মকর্তারা কাজ করবেন) এবং ৩ হাজার ২২৪টি নন-ক্যাডার পদ থাকবে। এসব পদে ধীরে ধীরে নিয়োগ দেওয়া হবে, যাতে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী স্তর পর্যন্ত পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করা যায়।
পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ঢাকা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে নতুন কাস্টমস কার্যক্রম শুরু হবে। এতে বিমান পরিবহন বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, পণ্য ছাড়, ও আন্তর্জাতিক যাত্রীদের সেবা আরও সহজ হবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা, এবং বেনাপোল বন্দরসহ দেশের প্রধান বাণিজ্য প্রবেশপথে কাস্টমস কার্যক্রম আধুনিকীকরণ ও ডিজিটাল রূপান্তরের আওতায় আনা হবে।
এছাড়া বিদ্যমান কমিশনারেট ও কাস্টমস হাউসগুলোতেও জনবল বৃদ্ধি ও কাঠামোগত সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এই উদ্যোগের ফলে অফিসগুলোর কাজের চাপ কমবে, তদন্ত ও নিরীক্ষা কার্যক্রমে গতি আসবে, এবং ব্যবসায়ীরা আরও দ্রুত ও কার্যকর সেবা পাবেন।
এনবিআর জানায়, রাজস্ব প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ কাস্টমস ও ভ্যাট গোয়েন্দা ইউনিটগুলোকেও বিকেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে। পূর্বে যেসব গোয়েন্দা কার্যক্রম শুধুমাত্র ঢাকাকেন্দ্রিক ছিল, তা এখন আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এতে তথ্য সংগ্রহ ও তদারকি কার্যক্রমের গতি বাড়বে, এবং ভ্যাট ফাঁকি ও কাস্টমস জালিয়াতি দমন আরও কার্যকর হবে।
একজন ঊর্ধ্বতন এনবিআর কর্মকর্তা বলেন, “এই পুনর্গঠন এনবিআরের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কর আহরণে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি করা, যাতে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।”
তিনি আরও বলেন, নতুন কমিশনারেট ও দপ্তরগুলো চালু হলে কর-জিডিপি অনুপাত উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহে আরও আত্মনির্ভর হবে, যা আন্তর্জাতিক ঋণনির্ভরতা কমাতে সহায়ক হবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৮.৩ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। নতুন দপ্তর গঠন ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে এনবিআর আগামী কয়েক বছরে এই অনুপাত ১২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। বিশেষ করে পরোক্ষ কর—যেমন ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক—সংগ্রহে স্বচ্ছতা, সহজীকরণ ও প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
এ বিষয়ে রাজস্ব নীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পুনর্গঠন উদ্যোগ শুধু কর আহরণ নয়, বরং অর্থনীতির সামগ্রিক কার্যকারিতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। ব্যবসায়িক পরিবেশ সহজ হওয়ায় নতুন বিনিয়োগ আসবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, এবং সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অভ্যন্তরীণ অর্থসংস্থান জোরদার হবে।
নতুন দপ্তর সৃষ্টির প্রস্তাবটি আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। প্রশাসনিক সব দপ্তরের অনুমোদনের পর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। বর্তমানে এনবিআরের মানবসম্পদ শাখা নিয়োগ ও অফিস স্থাপনের কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপে যেসব এলাকায় রাজস্ব সংগ্রহের সম্ভাবনা বেশি, সেখানে কমিশনারেট স্থাপনের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট অঞ্চলে নতুন ভ্যাট কমিশনারেট ও কাস্টমস হাউস স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এই পুনর্গঠন পরিকল্পনা কার্যকর হলে, এনবিআরকে আধুনিক কর প্রশাসনে পরিণত করার যে দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা সরকার হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নের পথে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে, এই উদ্যোগ “একটি রূপান্তরমূলক প্রশাসনিক মাইলফলক”, যা শুধু রাজস্ব আদায় নয়, বরং প্রশাসনিক দক্ষতা, জবাবদিহিতা, এবং নাগরিকবান্ধব সেবা নিশ্চিতে নতুন যুগের সূচনা করবে।
সার্বিকভাবে, নতুন ১২টি দপ্তর ও ৩৫৯৭ জনবল নিয়োগের এই সিদ্ধান্ত কাস্টমস ও ভ্যাট ব্যবস্থাকে নতুন গতিতে এগিয়ে নেবে—যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ পরিবেশ, ও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব প্রবৃদ্ধির জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ