
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে একটি গার্মেন্ট ও কেমিক্যাল গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গতকাল বেলা পৌনে ১২টার দিকে শিয়ালবাড়ির একটি চার তলা ভবনে ‘আনোয়ার ফ্যাশন’ নামে একটি গার্মেন্টে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পাশের শাহ আলম কেমিক্যাল গুদামে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। কিন্তু বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের কারণে আগুনের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খায় ফায়ার সার্ভিস। প্রায় তিন ঘণ্টার চেষ্টায় গার্মেন্টের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ফায়ার সার্ভিস সন্ধ্যা পর্যন্ত গার্মেন্টের ভিতর থেকে ১৬টি লাশ উদ্ধার করে। লাশগুলো পুড়ে রীতিমতো অঙ্গার হয়ে গেছে। তবে এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন গার্মেন্ট কর্মীরা। আগুনের সংবাদ শুনে অজানা আশঙ্কায় গার্মেন্টের দিকে ছুটতে থাকেন স্বজনরা। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে নিখোঁজদের খোঁজে ঘটনাস্থলে ভিড় করেন তারা।
নিখোঁজদের ছবি হাতে নিয়ে বিলাপ করতে দেখা গেছে তাদের। এ সময় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। এরপর তাদের সঙ্গে সহায়তায় যোগ দেন পাশে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবক, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ফায়ার সার্ভিস বলছে, নিহতদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হবে। গোডাউনে ব্লিচিং পাউডার, প্লাস্টিক, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও বিভিন্ন কেমিক্যাল থাকার কারণে আগুনের তীব্রতা ভয়াবহ রূপ নেয় বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করেছেন সিআইডির ক্রাইম সিন ও কেমিক্যাল ল্যাব বিশেষজ্ঞরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎ করে ‘আনোয়ার ফ্যাশন’ গার্মেন্ট ভবনের নিচ তলায় বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পান তারা। মুহূর্তেই আগুন জ্বলতে দেখেন গার্মেন্ট ও পাশে থাকা রাসায়নিকের গুদামে। খবর পেয়ে একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে অগ্নিনির্বাপণে কাজ শুরু করে। জানা গেছে, পোশাক কারখানার নিচ তলায় ওয়াশ ইউনিট রয়েছে। সেখানে প্রথম আগুন লাগে। সেই আগুন পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর আগুন চার তলা পোশাক কারখানার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর কারখানা থেকে শ্রমিকেরা নানাভাবে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই অনেকে আটকা পড়েন। সরেজমিন দেখা যায়, নিখোঁজদের খোঁজে ঘটনাস্থল ছবি হাতে ছোটাছুটি করছেন স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে অগ্নিদুর্ঘটনাকবলিত স্থান ও আশপাশের সড়ক।
১৪ বছর বয়সি ভাগনি মাহিরার ছবি হাতে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমার ভাগনি মাহিরা পোশাক কারখানার তিন তলায় কাজ করত। তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আগুন লাগার পর থেকে আমরা তাকে খুঁজছি। আশপাশের হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি, কোথাও পাইনি। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বলেছেন ধৈর্য ধরতে। নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম বলেন, আমার বোন সকাল পৌনে ৮টায় কাজে আসে। বেলা সাড়ে ১১টায় খবর পাই আগুন লেগেছে। সেখানের একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানতে পারি কেউ ভিতর থেকে বের হতে পারেনি। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাইনি। এখনো কোনো খোঁজ নেই আমার বোনের। এই গার্মেন্টে কারখানাতেই কাজ করতেন ২০ বছর বয়সি রবিউল্লাহ। সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। ছেলের খোঁজে ছুটছেন মা- একবার পুলিশের দিকে, একবার সেনাবাহিনীর কাছে, আবার ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের কাছে। কোথাও থেকে কোনো খবর মিলছে না। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছেলেটা আমার বেঁচে আছে তো? আবার চোখ মুছে তাকাচ্ছেন আগুনের ধোঁয়ায় ঢেকে থাকা ভবনের দিকে।
গার্মেন্টের দুই ফ্লোরে প্রায় ১০০ জন ছিলেন বলে জানিয়েছেন আরও কয়েকজন স্বজন। ফায়ার সার্ভিস বলছে, কর্মস্থলেই বিষাক্ত ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন পোশাক কারখানাটির ওপর তলায় থাকা কর্মীরা। পরে সেই ভবনের ওপরের দিকে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়লে পুড়ে অঙ্গার হতে হয় তাদের। এ ছাড়া গার্মেন্ট ভবনের ছাদের দরজায় দুটি তালা লাগানো ছিল। এর ফলে কারখানার শ্রমিকরা কেউ ওপরে উঠতে পারেননি। গার্মেন্টের ভবন ও রাসায়নিকের গুদাম কোনোটিরই অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেছেন, গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পুরোপুরি নেভেনি। এ আগুন নেভাতে কয়েকদিন লাগতে পারে। আজ বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল পরিদর্শনের পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ১৬ জনের লাশ পেয়েছি। ধারণা করছি কেমিক্যাল গোডাউনে যখন আগুন লাগে, তখন বিস্ফোরণের ফলে বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। যারা মারা গেছেন তারা হয়তো বিস্ফোরণের পর বিষাক্ত গ্যাসের কারণে বের হতে পারেননি এবং ঘটনাস্থলে মারা যান। তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ আমরা বিস্তারিত তদন্ত করে জানতে পারব।’ এদিকে ঢামেক হাসপাতাল সূত্র বলছেন, অগ্নিকাণ্ডে মামুন (৩৫), সোহেল (৩২) ও সুরুজ (৩০) নামে তিনজনকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, ‘সুরুজের শরীরের ২ শতাংশ দগ্ধসহ ইনহ্যালেশন ইনজুরি এবং মামুন ও সোহেলের ইনহ্যালেশন ইনজুরি রয়েছে। বর্তমানে তাঁদের জরুরি বিভাগের অবজারভেশনে রাখা হয়েছে। তাঁদের শরীর স্ট্যাবল হলে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ আহত মামুনের আত্মীয় জোছনা জানান, মামুন ও সোহেল এআর ফ্যাশনে চাকরি করেন। মামুন কাটিং মাস্টার হিসেবে এবং সোহেল ফিনিশিংয়ের কাজ করেন। অন্যদিকে সুরুজ এ গার্মেন্টে যে পণ্য অর্ডার দেওয়া ছিল, সেগুলো কোয়ালিটি চেক করার জন্য এসেছিলেন।
নিখোঁজ যারা : রাত ১২টা পর্যন্ত ১৬ জন নিখোঁজ ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে। তাঁদের স্বজনরা ঘটনাস্থলে এনসিপির সহায়তা বুথে গিয়ে নিখোঁজদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। এঁরা হলেন আবদুল আলিম (১৪), রিনা (১৭), সামিয়া (১৮), আসমা (১৪), তোফায়েল আহমেদ (১৮), মাহি (১৬), ছানোয়ার হোসেন, আলো (১৬), জয় (২০), মণি (১৪), খালিদ হাসান (২৯), মৌসুমী (১৮), আল মামুন (৮), ফারজানা বেগম (১৭), রতন (১৪) ও রবিন (১৬)। নিখোঁজদের তালিকায় নয়জন পুরুষ ও সাতজন নারী রয়েছেন। আর ময়নাতদন্তের জন্য ১৬ লাশ পাঠানো হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। ওই লাশগুলোর মধ্যেও নারী সাতজন ও পুরুষ নয়জন বলে জানিয়েছেন ঢামেক পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ (ইন্সপেক্টর) মো. ফারুক।
প্রধান উপদেষ্টার শোক : এ ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোকবার্তায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক। আমরা এ শোকের সময়ে তাঁদের পরিবারের পাশে আছি।’ অগ্নিকাণ্ডে আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দেন তিনি।
আর্থিক সহায়তার ঘোষণা জামায়াতের : রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গভীর শোক ও দুঃখপ্রকাশ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জামায়াতের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে। নিহতদের পরিবারগুলোর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে অন্যদের প্রতিও আহ্বান জানান তিনি।
বিজিএমইএ’র শোক : গতকাল এক বিবৃতিতে পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ মিরপুরে শাহ আলী ওয়াশিং লিমিটেড ও রাসায়নিক গোডাউনে আগুন লেগে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছে।
পাশাপাশি নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা ও আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে। সংশ্লিষ্ট সবার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে যে কারখানায় আগুন লেগেছে, তা বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কোনো পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি ওয়াশিং কারখানা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ