
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ রুপালি ইলিশের প্রজনন মৌসুম চলছে। প্রতিবছরের মতো এবারও মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে দেশের নদ-নদী, মোহনা ও উপকূলীয় সমুদ্রসীমায় ২২ দিনের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এ সময় সারাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ জেলে তাদের ট্রলার ও জাল ঘাটে বেঁধে রেখেছেন।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার মৎস্য ঘাটগুলো ঘুরে দেখা গেছে, মাছ ধরা বন্ধ থাকায় এখন সেখানে বিরাজ করছে নীরবতা। কোড়ালিয়া, গহিনখালী, ছোটবাইশদিয়া সহ বিভিন্ন গ্রামের শত শত ট্রলার আর জাল স্তূপ করে রাখা হয়েছে। উপকূলজুড়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবী।
কিন্তু মা ইলিশ সংরক্ষণের এই উদ্যোগের মধ্যেই দানা বাঁধছে উদ্বেগ, ক্ষোভ ও হতাশা। কারণ, উপকূলের জেলেদের দাবি—তাদের দেশের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে প্রতিবেশী ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জেলেরা আবার সাগরে মাছ ধরতে নামবেন। ফলে একদিকে বাংলাদেশের জেলেরা নিষেধাজ্ঞা মেনে ঘাটে বসে থাকলেও, অন্যদিকে ভারতের জেলেরা একই বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে নামলে সংরক্ষণের এই উদ্যোগ কি আদৌ সফল হবে?
বাংলাদেশ সরকার যেখানে ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেখানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিয়েছে মাত্র ১১ দিনের নিষেধাজ্ঞা—২ অক্টোবর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত। ফলে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার মাঝপথেই ভারতের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। তখন ভারতীয় জেলেরা মাছ ধরতে সাগরে নামলে মা ইলিশের নিরাপদ প্রজনন ব্যাহত হতে পারে বলেই মনে করছেন উপকূলের জেলেরা, বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা।
রাঙ্গাবালীর কোড়ালিয়া মৎস্যঘাটে ট্রলার মালিক মিথেল হাওলাদার বলেন, “আমরা সরকারের আইন মেনে ২২ দিন সাগরে যাই না। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে ভারতের জেলেরা সাগরে মাছ ধরবে, তখন আমাদের মা ইলিশ রক্ষা হবে কীভাবে? ইলিশ তো সীমানা বোঝে না। মা ইলিশ তো পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে সাঁতরে চলে না। তখন তাদের জালে ধরা পড়লে আমরা পরে সাগরে গিয়ে কীভাবে মাছ ধরব?”
একই এলাকার জেলে মজিবর প্যাদা বলেন, “আমরা ঘাটে বসে থাকি, অথচ পাশের দেশের জেলেরা মাছ ধরে নিয়ে যায়—এটা তো আমাদের সঙ্গে অন্যায়। তখন আমরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হব। সরকারের উচিত নজরদারি বাড়ানো, যাতে তারা আমাদের সীমানায় না ঢোকে।”
জেলেরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, নিষেধাজ্ঞার এই সময়টাতে ভারতীয় কিংবা অন্য দেশের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরার চেষ্টা করতে পারে। অতীতেও এ ধরনের অভিযোগ ছিল। তাই তারা কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম জানান, “আমাদের ৯০ শতাংশ ইলিশই বাংলাদেশ জলসীমায় এসে ডিম ছাড়ে। ফলে আশঙ্কার কিছু নেই। আমাদের নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড সাগরে কঠোর নজরদারি রাখছে।” তিনি আরও বলেন, “প্রতিবেশী দেশ কী করল, সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। আমাদের দায়িত্ব নিজেদের জলসীমা রক্ষা করা।”
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, “ইলিশ একটি অভিন্ন প্রজাতি। তারা একই সাগরে বিচরণ করে। তাহলে এক দেশের নিষেধাজ্ঞা ২২ দিন আর অন্য দেশের মাত্র ১১ দিন কেন? এ ধরনের ভিন্নতা ইলিশ সংরক্ষণের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের দেশের নিষেধাজ্ঞা বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকরী। তবে ইলিশের বিচরণ সীমান্তজ্ঞানহীন। তাই এককভাবে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা সম্ভব নয়। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে যদি একযোগে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মাছ ধরা বন্ধ রাখা যায়, তাহলে মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারবে। ফলাফল হবে দীর্ঘমেয়াদি।”
মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রজননকালীন সময় ইলিশ ধরা বন্ধ রাখলে মাছের সংখ্যা ও ওজন দুটোই বাড়ে। ফলে পরবর্তী মৌসুমে জেলেরা বেশি মাছ ধরতে পারেন। তবে তাতেও উপকূলীয় জেলেদের দুর্ভোগ কমছে না। নিষেধাজ্ঞার সময় জীবিকার জন্য সরকারের প্রণোদনা বা সহায়তা খুবই সীমিত।
মজিবর প্যাদা বলেন, “মাসে দুইবার চাল পাই, কিন্তু পরিবারের খরচ, বাচ্চাদের পড়াশোনা, চিকিৎসা—সব কিছু চলে না তো সেই চালে। নিষেধাজ্ঞার সময়েও তো আমাদের খেতে হয়, বাঁচতে হয়। শুধু নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দায় শেষ করলে চলবে না, আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
জেলেদের মতে, সরকারি সহায়তার পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম হাতে নেওয়া জরুরি, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার সময় অন্য উপায়ে উপার্জন করতে পারেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইলিশ সংরক্ষণে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে সমুদ্রসংলগ্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে একটি সমন্বিত সময়সূচি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে সব দেশ একই সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখে।
মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, “ইলিশ আমাদের জাতীয় সম্পদ, অর্থনীতির চালিকাশক্তি এবং উপকূলীয় লাখো মানুষের জীবিকার ভরসা। এটা শুধু এক দেশের একক উদ্যোগে রক্ষা করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সমন্বয় ছাড়া ইলিশের প্রজনন নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।”
উল্লেখ্য, চলতি বছর বঙ্গোপসাগরে মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বাড়াতে ভারত ও বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার সময় প্রথমবারের মতো কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছিল। আগে যেখানে বাংলাদেশ ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিত, এবার তা ৫৮ দিনে নামিয়ে আনা হয়েছে—ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
এই পদক্ষেপে জেলেরা স্বস্তি পেয়েছিলেন। তারা আশা করেন, ভবিষ্যতে ইলিশের প্রজনন মৌসুমেও একইভাবে দুই দেশের নিষেধাজ্ঞা এক করে দেওয়া হবে।
মা ইলিশ সংরক্ষণে বাংলাদেশের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এই উদ্যোগকে পুরোপুরি সফল করতে হলে সমুদ্রসীমায় নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার করা জরুরি। কারণ, ইলিশ কখনোই সীমান্ত চিনে চলাফেরা করে না।
বাংলাদেশের উপকূলের লাখো জেলে আজ কেবল একটি প্রশ্নের উত্তর চান—"আমরা যদি আইন মানি, অন্যরা যদি না মানে, তাহলে আমাদের আত্মত্যাগের সুফল কোথায়?"
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করাই এখন সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ