
ছবি: সংগৃহীত
দেশের স্বর্ণবাজারে আবারও নতুন রেকর্ড। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ভরিতে ১ হাজার ৪৬৯ টাকা বাড়িয়ে স্বর্ণের সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। এখন থেকে দেশের বাজারে ২২ ক্যারেট মানের এক ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) স্বর্ণ কিনতে হলে গ্রাহকদের ব্যয় করতে হবে ২ লাখ ২ হাজার ১৯৫ টাকা—যা দেশের ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম।
বাজুস সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) রাতে এ দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসে এবং নতুন এই মূল্য বুধবার (৮ অক্টোবর) থেকেই কার্যকর হয়েছে।
স্বর্ণের এই অতীত অতিক্রমকারী দাম বৃদ্ধি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই স্বর্ণের বাজার ও সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকে এ ঘটনাকে স্বর্ণের বাজারে অস্থিরতার ধারাবাহিকতা বলছেন, কেউ আবার এর পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকটকে দায়ী করছেন।
মাত্র একদিন আগেই, অর্থাৎ সোমবার (৬ অক্টোবর) বাজুস ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম প্রতি ভরিতে ৩ হাজার ১৫০ টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৭২৬ টাকা নির্ধারণ করেছিল। তখনও সেটি ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেই দামকে ছাপিয়ে আরও একধাপ ওপরে উঠে এলো স্বর্ণের বাজার।
নতুন মূল্যহার অনুযায়ী:
-
২২ ক্যারেট স্বর্ণ: প্রতি ভরি ২,০২,১৯৫ টাকা
-
২১ ক্যারেট স্বর্ণ: প্রতি ভরি ১,৯৩,০০৪ টাকা
-
১৮ ক্যারেট স্বর্ণ: প্রতি ভরি ১,৬৫,৪৩১ টাকা
-
সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ: প্রতি ভরি ১,৩৭,৪৭২ টাকা
বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, স্বর্ণের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে অবশ্যই সরকার নির্ধারিত ৫% ভ্যাট এবং বাজুস নির্ধারিত ন্যূনতম ৬% মজুরি যোগ করতে হবে। তবে গহনার নকশা ও মান অনুযায়ী এই মজুরি আরও বাড়তে বা কমতে পারে।
ঢাকার গুলিস্তান, নিউমার্কেট ও উত্তরা এলাকার কয়েকটি জুয়েলারি দোকান ঘুরে দেখা যায়, দাম বৃদ্ধি নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ ও হতাশা। অনেকেই পুরোনো গয়না বিক্রি করতে এসেছেন, আবার অনেকে কেনা স্থগিত রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
জুয়েলারি ব্যবসায়ী সমিতির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বাজারে যেভাবে দাম বাড়ছে, তাতে সাধারণ ক্রেতাদের পক্ষে স্বর্ণ কেনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অনেকে বিয়ের গয়না কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছেন। অন্যদিকে, আমাদেরও চালানে সমস্যা হচ্ছে, কারণ যারা পণ্যের দাম কম থাকতে অর্ডার দিয়েছিলেন, এখন তারা পেছিয়ে যাচ্ছেন।”
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির এই ধারা ২০২৫ সালের শুরু থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি বছরে এ নিয়ে মোট ৬২ বার দেশের বাজারে স্বর্ণের মূল্য সমন্বয় করেছে বাজুস। এর মধ্যে ৪৪ বার দাম বাড়ানো হয়েছে, আর কমানো হয়েছে মাত্র ১৮ বার।
তুলনামূলকভাবে ২০২৪ সালে মোট ৬২ বার দাম সমন্বয় করা হয়েছিল, যার মধ্যে ৩৫ বার দাম বেড়েছিল এবং ২৭ বার কমেছিল। অর্থাৎ, ২০২৫ সালে স্বর্ণের বাজার আরও বেশি ওঠানামার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এবং মূল্যবৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি।
স্বর্ণের পাশাপাশি রুপার দামেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ২২ ক্যারেট রুপার দাম ভরিতে ১ হাজার ২৬ টাকা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৬৫৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে রুপার সর্বোচ্চ মূল্য।
রুপার নতুন মূল্যহার হলো:
-
২২ ক্যারেট রুপা: ৪,৬৫৪ টাকা
-
২১ ক্যারেট রুপা: ৪,৪৪৪ টাকা
-
১৮ ক্যারেট রুপা: ৩,৮০২ টাকা
-
সনাতন পদ্ধতির রুপা: ২,৮৫৮ টাকা
বাজুসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণ তথা পিওর গোল্ডের দাম বেড়েছে। সেইসঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব এবং ডলারের সংকট মাথায় রেখেই নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।”
বিশেষজ্ঞ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে বাংলাদেশের স্বর্ণবাজারে এমন ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে।
১. আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি: ইউএস ডলার ও জিও-পলিটিক্যাল অস্থিরতা, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের যুদ্ধাবস্থা স্বর্ণের চাহিদা বাড়িয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে দেশে।
২. ডলার সংকট: বাংলাদেশে আমদানি কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটছে। ডলারের অভাবে স্বর্ণ আমদানিতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।
৩. মুদ্রাস্ফীতি ও আর্থিক অনিশ্চয়তা: সাধারণ জনগণ নগদ অর্থ বা ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে স্বর্ণে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ মনে করছেন।
৪. উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি: দেশীয় উৎপাদন বা কারিগরি খরচ বেড়ে যাওয়াও এই দামের সমন্বয়ে প্রভাব ফেলেছে।
স্বর্ণের বাজারে এমন লাগামহীন দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন—এখন স্বর্ণ কিনবেন, নাকি অপেক্ষা করবেন?
বাজার বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, যাদের বাস্তব প্রয়োজন (যেমন: বিয়ে, পারিবারিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি) তারা স্বর্ণ কিনলেও অন্যদের আপাতত বাজার পর্যবেক্ষণ করতে বলা হচ্ছে। কারণ, এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধির পর কিছুটা সংশোধন বা স্থিতিশীলতা আসার সম্ভাবনা থাকে।
বর্তমানে স্বর্ণ আমদানির জন্য বাজেয়াপ্ত শুল্ক হার ও আনুষ্ঠানিক আমদানির প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় কালোবাজার ও অবৈধ পথে স্বর্ণ আসার প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারের উচিত একটি স্বচ্ছ ও বাস্তবভিত্তিক আমদানি নীতি প্রণয়ন করা, যাতে বাজারে স্বর্ণের জোগান ঠিক থাকে এবং দাম সহনীয় হয়।
স্বর্ণ একসময় শুধু অলংকারের উপাদান ছিল, এখন এটি নিরাপদ বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে স্বর্ণ এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজুসের এ একদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো রেকর্ড ভাঙা দামের ঘোষণা আরও একবার প্রমাণ করল—স্বর্ণের বাজার এখন চরম অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে।
যদিও বাজুস বলছে, তারা আন্তর্জাতিক বাজার ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনা করেই দাম নির্ধারণ করছে, তবু সাধারণ জনগণের প্রশ্ন—স্বর্ণ কি এখন কেবল ধনীদের জন্য সংরক্ষিত হচ্ছে?
এমন প্রশ্নের উত্তর, এবং এই বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখাই এখন নীতিনির্ধারকদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ