
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তে বিন্যস্ত নাফ নদ এখন আর কেবল জীবিকার উৎস নন—এটি হয়ে উঠেছে ভয়ের প্রতীক। প্রতিদিন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে নাফের জোয়ার-ভাটায় নামা বাংলাদেশের জেলে সম্প্রদায়ের পক্ষে দিনশেষে ঘরে ফিরে যাওয়াই আপাত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে মিয়ানমারের আত্মঘোষিত সশস্ত্র দল আরাকান আর্মি (আরএএ) অনবরত বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে—গত কয়েক মাসে এই ঘটনার সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে।
এই বছর ৫ আগস্ট থেকে ২৮ আগস্টের ২৩ দিনে বিষদ তথ্যানুযায়ী অন্তত ৬৯ জন জেলে আরাকান আর্মির হাতে আটক হন। এর মধ্যে ১৭ আগস্ট ৯ জন, ২৩ আগস্ট ১২ জন, ২৪ আগস্ট ১৪ জন, ২৫ আগস্ট ৭ জন, ২৬ আগস্ট ১৩ জন এবং ৩০ সেপ্টেম্বর দু’টি ট্রলারসহ ১৪ জন জেলে অপহৃত হন—এগুলো কেবল এক অংশ; এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর ৫টি ট্রলারে করে ৪০ মাঝিমাল্লা অপহরণ করা হয়েছিল। সেই অপহরণে একটি ট্রলারের ১৭ জন জেলে কৌশলে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে আরাকান আর্মির কাছে বর্তমানে প্রায় ১১৪ জন জেলে বন্দি রয়েছেন এবং একই কালে তারা ১৯টি ট্রলার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে বলে স্থানীয় সূত্র জানাচ্ছে। জুন পর্যন্ত তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, এ বছরের প্রথমার্ধেই প্রায় ১৬৫ জন জেলে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর ছিল। কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কিছু জেলেকে ফেরত আনা গেলেও বহু পরিবার এখনও আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার জীবনযাপন করছে।
নাফনদীর তীরবর্তী গ্রামগুলোতে এখন প্রতিদিনের কথাবার্তা হলো—কে আবার বাড়ি ফিরবে? কার বাপ-মা বা ছেলে–বেনী সন্ধানহারা? অপহৃতদের পরিবারগুলো মানসিক চাপ, দরিদ্রতা এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার সাথে বসবাস করছে। ভাঙা গ্রামমুখ, নিঃশব্দ ঘর ও অস্থির রাত—এ সব এখন নাফের পাড়ের সাধারণ চিত্র। জলজ জীবিকার উপর নির্ভরশীল এই মানুষেরা বলতে দূর, অনেকে সহযোগীভাবে নামেন—কিন্তু ফেরার গোপন আশাও নেই।
বন্দর সুরক্ষা বাহিনী ও সামরিক কর্তৃপক্ষকে স্থানীয় জনগণ সমর্থন করলেও তাদের কথায়-প্রতিবাদে সীমাবদ্ধতা ও বাস্তব সীমারেখা বর্ণিত হচ্ছে। কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার সালাউদ্দিন রশিদ তানভির জানিয়েছেন, “বেশিরভাগ জেলে মাছ ধরতে গিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যান; তখন তাকে আটক করা হয়। তারপরও আমরা খতিয়ে দেখছি—এই জেলেরা আসলেই কারা।” তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের জলসীমায় আরাকান আর্মি এসে জেলে ধরে নিয়ে যাওয়া আমি মেনে নেব না; আমরা তা হতে দেব না।” তবে তিনি একই সাথে রোখা–টোকা ও জাল টানার মতো অনিচ্ছাকৃত সীমা লঙ্ঘনের কারণটিও উল্লেখ করেছেন।
কক্সবাজার রামুর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন বলেন, আরাকান আর্মি কেবল সশস্ত্র বিদ্রোহী নয়—তারা মাদক চক্র ও মানবপাচারে জড়িত এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে এসব অবৈধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার কারণে সেখানকার স্বীকৃত কোনো কেন্দ্রীয় সরকার না থাকায় কূটনৈতিক যোগাযোগ–আলাপচারিতাও প্রায়শই ব্যাহত হচ্ছে। তারপরও সেনা ও কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করে আটক জেলেদের ফেরত আনতে সশ্রদ্ধ চেষ্টা চালানো হচ্ছে—এটাই তাদের দাবি।
নাফ নদকে কেন্দ্র করে ইতিহাসে একবার বড় টানাপোড়েন বিদ্যমান—২০০০ সালে বাংলাদেশের সামরিক বিপর্যয় মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিল, যখন তৎকালীন ঘটনা সামরিক কৌশলে সামলানো হয়েছিল। সেই 'নাফ যুদ্ধ'–এর স্মৃতি এখন প্রশ্ন তুলছে—এই অস্থিরতা কি আবার যুদ্ধের সূত্র রচনা করবে? অনেকেই জানতে চাচ্ছেন, কেবল কূটনৈতিক প্রতিবাদ কি যথেষ্ট হবে, নাকি কড়া প্রতিরোধী মেসেজ দেওয়াই হবে কার্যকর? অতীতের ঘটনাবলি ও সাম্প্রতিক অপহরণ ঢেউ বিবেচনা করে জনগণের মধ্যে সতর্ক সন্দেহ ও উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে।
বহু বিশ্লেষক মনে করেন, আরাকান আর্মির কার্যকলাপ সীমান্ত সমস্যা অতিক্রম করে আগ্রাসনমূলক আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিৎ। আন্তর্জাতিক আইনের দিক থেকে নবান্ন বা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সীমান্ত নদীতে সংহত শান্তিপূর্ণ চলাচলের অধিকার থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে সেখানে 'গোপন নিষেধাজ্ঞা' আরোপ করে আরাকান আর্মি নৌযান ও মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্থ করছে—এটি বৈশ্বিকভাবে উদ্বেগের বিষয়। রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনী সরানো বা শক্তিগত শূন্যতার পর আরাকান আর্মি তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ফলে তারা নিজেদের নিয়ম জারি করে চলেছে।
এই অবস্থা মোকাবিলায় যে কূটনৈতিক হাতছানির কথা বলা হচ্ছে—তাও কিছুই সহজ নয়। কারণ মিয়ানমারে সরকার নেই বা ক্ষমতার শূন্যতা বিদ্যমান বলে সরাসরি কূটনৈতিক আলোচনার পথ সবসময় খোলা থাকে না। তবু বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিকাঠামো, জাতিসংঘ ও পাশে থাকা আন্তর্জাতিক মঞ্চ ব্যবহার করে এই ইস্যুটি তোলা সম্ভব; একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃষ্টিগোচর করাতে না হলে সমাধান শঙ্কিত। বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক চাপের পাশাপাশি সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার, কোস্টগার্ড–নৌবাহিনী সমন্বয় উন্নতকরণ, জেলেদের জন্য স্থানীয় সতর্কতামূলক নীতি এবং অপহরণরোধী অভিযান যৌথভাবে কার্যকর হতে পারে।
নাফের পাড়ের মানুষদের জীবনযাত্রা এখন একেবারে ভাঙাচোরা। জেলেদের পরিবারের নিত্যাবশ্যক খরচ, শিক্ষাবিধি, ঋণ–লিপ্ততা ও মানসিক চাপ—এগুলো সবই বাড়ছে। ট্রলার, যন্ত্রপাতি ও জালের অপহরণ অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি ক্ষতগ্রস্ত আস্থা ফিরিয়ে আনে না। বহু পরিবার এখন ভ্রাম্যমাণ জীবনযাত্রার দিকে ধাবিত—কেউ শক্ত মনে জীবিকা নির্বাহ বন্ধ না করে অন্য পথে যাবার চিন্তা করছে।
এই সংকট উত্তরণের জন্য অনেক স্তরের সমাধান দরকার—স্থায়ী কূটনৈতিক উদ্যোগ, আঞ্চলিক সহযোগিতা, সীমান্তে তৎপর নজরদারি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি বিবেচনা, ও সবচেয়ে জরুরি—নির্বিচারে জেলেদের জীবন-চলাচলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। যে নাফ নদ এক সময় বাংলাদেশের গৌরবগাথা লিখেছিল, আজ তার ঢেউ লিখছে শঙ্কা ও আতঙ্কের গল্প—এটা ফিরিয়ে আনার দায় বর্তমান নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উপরে বর্তায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ