
ছবি: সংগৃহীত
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ও পৌরসভায় টানা আট দিন ধরে জারি থাকা ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ায় আগামীকাল রোববার (৬ অক্টোবর) ভোর ৬টা থেকে এই ধারা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
শনিবার (৫ অক্টোবর) রাত ৯টার দিকে জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার স্বাক্ষরিত এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। একই দিন গুইমারা উপজেলাতেও অনুরূপভাবে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আইরিন আক্তার।
খাগড়াছড়ি জেলায় কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। গত ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুর ২টা থেকে জেলা সদর ও পৌর এলাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে এবং জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
পাহাড়ের রাজনীতি ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন, বিক্ষোভ, এবং অবরোধ কর্মসূচির কারণে প্রশাসনকে কঠোর অবস্থান নিতে হয়। বিশেষত “জুম্ম ছাত্র-জনতা” নামের একটি সংগঠনের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে। এই অবরোধ চলাকালে জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়, এবং সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির মুখে পড়ে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেলার বিভিন্ন স্পটে টহল জোরদার করে। জেলা প্রশাসনও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও সামাজিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় জুম্ম ছাত্র-জনতা সংগঠনটি শনিবার (৫ অক্টোবর) সকালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘স্থগিত অবরোধ’ কর্মসূচি পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেয়। তারা জানায়, প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনার ফলেই এ সিদ্ধান্ত এসেছে এবং তারা এখন শান্তিপূর্ণ সমাধানে আগ্রহী।
জেলা প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ও পৌরসভা এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। প্রশাসন ও স্থানীয় নেতাদের উদ্যোগে জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকেও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের সুপারিশ পাওয়া গেছে।
তাই ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ অনুযায়ী জারি করা ১৪৪ ধারার নির্দেশনা রোববার ভোর ৬টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করা হবে। এর ফলে সাধারণ জনগণ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা, সভা, সমাবেশ ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন।
এদিকে খাগড়াছড়ির পার্শ্ববর্তী গুইমারা উপজেলায় একই দিন পৃথক এক বিজ্ঞপ্তিতে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ইউএনও আইরিন আক্তার। তিনি জানান, স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে এসেছে। সম্প্রতি এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এবং জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
খাগড়াছড়িতে উত্তেজনার সূত্রপাত হয়েছিল এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ ঘিরে। এই ঘটনায় এলাকাজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, এবং পাহাড়ি সংগঠনগুলো বিক্ষোভে নামে। পরে মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সংগঠন নতুন করে আন্দোলন ও অবরোধের ঘোষণা দেয়। প্রশাসন তখন জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ১৪৪ ধারা জারি করে।
প্রশাসনের এই ঘোষণার পর স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন। টানা এক সপ্তাহ ধরে খাগড়াছড়ি শহরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকই বন্ধ ছিল, যান চলাচল সীমিত ছিল, আর বাজারে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল।
জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা চাই মানুষ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরুক। প্রশাসন, পুলিশ এবং স্থানীয় সমাজপতিদের সহযোগিতায় শান্তি ফিরেছে—এটি ধরে রাখতে সবাইকে দায়িত্বশীল থাকতে হবে।”
দীর্ঘ আট দিনের অচলাবস্থার পর অবশেষে খাগড়াছড়ি আবার শান্তির পথে ফিরছে। অবরোধ প্রত্যাহার, প্রশাসনের উদ্যোগ, এবং জনগণের ধৈর্যের ফলেই এই পরিস্থিতি এসেছে। এখন প্রশাসনের লক্ষ্য হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও স্থায়ী সমাধানের দিকে অগ্রসর হওয়া, যাতে ভবিষ্যতে এমন উত্তেজনা আর না দেখা দেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ