
ছবি: সংগৃহীত
দেশে বিচার ব্যবস্থায় প্রযুক্তির নতুন অধ্যায় সূচিত হতে যাচ্ছে। বুধবার (১৫ অক্টোবর) থেকে কার্যকর হতে যাচ্ছে ডিজিটাল জামিননামা বা অনলাইন বেইল বন্ড ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে আদালত থেকে জামিন মঞ্জুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এক ক্লিকেই সেই আদেশ সরাসরি সংশ্লিষ্ট কারাগারে পৌঁছে যাবে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং হয়রানিমূলক ১২ ধাপের প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি পাবেন সাধারণ মানুষ ও তাদের স্বজনরা।
এই যুগান্তকারী উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি এ তথ্য জানান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। উপস্থিত ছিলেন বিচার বিভাগ ও আইনজীবী সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিরাও।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, “আগামীকাল বুধবার থেকে অনলাইন বেইল বন্ড (ডিজিটাল জামিননামা) চালু করা হবে। এখন আদালত থেকে এক ক্লিক করলেই জামিন আদেশ সরাসরি সংশ্লিষ্ট জেলখানায় পৌঁছে যাবে, যেখানে আসামি অবস্থান করছে। এতে আর কোর্টের দৌড়ঝাঁপ, ঘুষ কিংবা ফাইল হারিয়ে যাওয়া—এসব সমস্যার অবসান ঘটবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই সিস্টেমটি আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে। এতে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা বা বেসরকারি সহযোগিতা নেওয়া হয়নি। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে আমরা এই ডিজিটাল রূপান্তর সম্পন্ন করেছি।”
বর্তমান ব্যবস্থায় আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর আসামি বা তার আত্মীয়দেরকে অন্তত ১২টি ধাপ পেরোতে হয়। কখনো কোর্ট থেকে কপি সংগ্রহ, কখনো ডুপ্লিকেট সনদ, কখনো কারাগারে অনুমোদন—প্রতিটি স্তরে ভোগান্তি, সময়ক্ষেপণ এবং অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
একই সঙ্গে বিচারপ্রার্থীদের মানবিক কষ্টও চরমে পৌঁছায়। জামিন পেলেও কারাগারে সেই আদেশ পৌঁছাতে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কখনো পুরো দিন। অনেক সময় সেই বিলম্বে আসামিকে রাত কাটাতে হয় কারাগারের ভেতরে। নতুন অনলাইন জামিননামা চালু হলে এসব হয়রানি পুরোপুরি বন্ধ হবে বলে আশা করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য হলো জনগণের হয়রানি বন্ধ করা। আদালত থেকে জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর আর কোনো অফিস বা কর্মচারীর কাছে যেতে হবে না। একটা ক্লিকেই সব হয়ে যাবে। আমরা চাই বিচার ব্যবস্থায় মানুষ সহজে ন্যায়বিচার পাক—এই ডিজিটাল জামিননামা সেই লক্ষ্যে একটি বড় পদক্ষেপ।”
তিনি জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিচার বিভাগ, কারা অধিদপ্তর এবং আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বিত একটি ডিজিটাল নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। আদালতের সফটওয়্যার থেকে সরাসরি তথ্য যাবে কারা কর্তৃপক্ষের সার্ভারে, যা একই সঙ্গে রেকর্ড ও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেবে।
ড. আসিফ নজরুল তার বক্তব্যে জানান, শুধু জামিন প্রক্রিয়াই নয়, বিচার ব্যবস্থার আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কার আনার কাজ চলছে। তার ভাষায়, “বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয় আমাদের সময়েই প্রতিষ্ঠিত হবে। বিচার বিভাগ পৃথক সচিবালয় আইন, গুমের আইন, দুদক আইন এবং হিউম্যান রাইটস আইন—সবগুলোই আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সম্পন্ন হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলতে চাই যেখানে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। জনগণ যেন মনে করে—এটা তাদের বিচারব্যবস্থা, কোনো দলীয় বা প্রশাসনিক নয়।”
আইনজীবীরা এই পদক্ষেপকে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় এক “ডিজিটাল বিপ্লব” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা মনে করছেন, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে আইনি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়বে, দুর্নীতির সুযোগ কমবে এবং বিচারপ্রার্থীদের আস্থা পুনরুদ্ধার হবে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এক সদস্য বলেন, “জামিনের আদেশ কোর্টে হওয়ার পর সেটি কারাগারে পৌঁছাতে অনেক সময় বিলম্ব হয়। এতে আসামি ও তার পরিবারকে চরম মানসিক কষ্ট পেতে হয়। এখন এক ক্লিকেই সেই আদেশ জেলে পৌঁছে গেলে এটা মানবিকতার দিক থেকেও বড় অর্জন হবে।”
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় প্রযুক্তি নির্ভর এই পরিবর্তনকে অনেকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হিসেবে দেখছেন। বহু বছর ধরে চলে আসা জটিল প্রক্রিয়া, ফাইলের পেছনে ঘোরাঘুরি এবং অর্থনৈতিক হয়রানির অবসান ঘটাতে এই উদ্যোগ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের কথায়, “আমরা চাই—মানুষ যেন বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশ করলেই সম্মান ও সহানুভূতি অনুভব করে। এই ডিজিটাল জামিননামা সেই পরিবর্তনের সূচনা।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ