
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন ট্যারিফ কার্যকর হওয়াকে ঘিরে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, আলোচনাবিহীনভাবে হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধি আমদানি খরচ ও ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়াবে, অন্যদিকে বন্দর কর্তৃপক্ষের যুক্তি—প্রায় চার দশক পর শুল্ক বাড়ানো ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্ভব নয়। সোমবার (১৩ অক্টোবর) রাত ১২টা থেকে নতুন ট্যারিফ কার্যকর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞপ্তি জারি করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, জেটি-শেড, টার্মিনাল ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয় মেটাতে ৩৮ থেকে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন হার কার্যকরের সিদ্ধান্ত হলেও ব্যবসায়ীদের অনুরোধে এক মাসের জন্য তা স্থগিত করা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম বন্দর সর্বশেষ ট্যারিফ বাড়িয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তখন মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ছিল প্রায় ৩০ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২২ টাকায়। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, এই মূল্যবৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত চাহিদা বিবেচনায় ট্যারিফ বাড়ানো সময়ের দাবি ছিল। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ট্যারিফ বাড়ানোর আগে কোনো স্টেকহোল্ডার পরামর্শ বা যৌথ আলোচনা হয়নি—যা ব্যবসায়িক স্বার্থের পরিপন্থী।
নতুন কাঠামো অনুযায়ী, পাইলটিং চার্জ ৮০০ মার্কিন ডলার এবং জাহাজ টানার টাগ চার্জ ৬১৫ থেকে ৬,৮৩০ ডলার পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। বেড়েছে কনটেইনার উঠানো-নামানোর চার্জ, বার্থে অবস্থান ফি এবং কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের খরচও।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ট্যারিফ বাড়ানো হলেও ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব সামান্য। বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, “হিসাব অনুযায়ী প্রতি কেজি আমদানি পণ্যে বাড়তি খরচ হবে মাত্র ১২ পয়সা। এটা ভোক্তা দামের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। ট্যারিফ বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্য অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের খরচ মেটানো।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে বন্দর থেকে অর্জিত আয়ের বড় অংশ উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে। জেটি ও টার্মিনাল সম্প্রসারণ ছাড়া বাণিজ্যের চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। নতুন ট্যারিফ থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে আমরা আরও আধুনিক বন্দরে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়েছি।”
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, সদ্য সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দরের মোট আয় ছিল ৫ হাজার ২২৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে নিট আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। অথচ, আগামী পাঁচ বছরে বন্দরের বিভিন্ন সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ব্যয় নির্ধারিত রয়েছে।
অন্যদিকে, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে শুধু আমদানি খরচ নয়, দেশের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যাবে। কারণ কাঁচামাল ও সমাপ্ত পণ্যে দুইবার শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক আমিরুল হক বলেন, “একই পণ্যের জন্য দুবার ট্যারিফ পরিশোধের এই নিয়ম অযৌক্তিক। কাঁচামাল আনার সময় একবার, আর পণ্য রফতানির সময় আবার দিতে হয়। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।”
বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান বলেন, “আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো—ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ভারত ও সিঙ্গাপুরের বন্দরে খরচ অনেক কম। অথচ সেবার মানে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে। নতুন ট্যারিফ আমাদের রপ্তানি খাতের জন্য আরেকটি ধাক্কা।”
ব্যবসায়ী মহলের আশঙ্কা, নতুন শুল্ক কার্যকর হলে পণ্য খালাসে বিলম্ব ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে। তারা অভিযোগ করেন, “বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা আয় করলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারছে না—জট, দেরি, ও ব্যয়বৃদ্ধি ক্রমেই বেড়ে চলেছে।”
নতুন ট্যারিফ অনুযায়ী, বার্থে জাহাজের অবস্থানকালীন অতিরিক্ত ফি বহুগুণে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন থেকে ১২ ঘণ্টা অতিরিক্ত অবস্থানের জন্য ১০০ শতাংশ, ২৪ ঘণ্টার জন্য ৩০০ শতাংশ, ৩৬ ঘণ্টার জন্য ৪০০ শতাংশ এবং ৩৬ ঘণ্টার বেশি অবস্থানের জন্য ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত চার্জ দিতে হবে। শিপিং ব্যবসায়ীদের মতে, এটি একধরনের “অযৌক্তিক চাপ”, কারণ অনেক সময় জাহাজ বিলম্ব হয় বন্দরের নিজস্ব প্রক্রিয়াজনিত কারণে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য বলেন, “জাহাজের বিলম্ব সবসময় আমদানিকারক বা রপ্তানিকারকের কারণে হয় না। অনেক সময় কনটেইনার হ্যান্ডলিং বা ক্লিয়ারেন্সের বিলম্ব ঘটে বন্দর ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে। অথচ তার দায়ভার এখন আমাদের ওপর চাপানো হচ্ছে।”
আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়েও চট্টগ্রাম বন্দর কিছুটা পিছিয়েছে। বিশ্বের ব্যস্ততম ১০০ বন্দরের তালিকায় এক ধাপ নেমে বর্তমানে এটি ৬৮তম স্থানে অবস্থান করছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ট্যারিফ প্রয়োগে বন্দরের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও দুর্বল হতে পারে।
এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ একাধিক ব্যবসায়ী সংগঠন নতুন ট্যারিফ কার্যকর স্থগিত করে যৌথ আলোচনার দাবি জানিয়েছে। তারা বলছে, “বন্দর, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিদের নিয়ে যৌথ আলোচনা ছাড়া নতুন শুল্ক বাস্তবায়ন করলে তা দেশের সামগ্রিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
বন্দর কর্তৃপক্ষ যদিও এখনই ট্যারিফ প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছে, তবে ব্যবসায়ী মহলের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সম্ভাব্য রপ্তানি সংকটের প্রেক্ষিতে সরকার এই বিষয়ে মধ্যস্থতা করতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
সব মিলিয়ে, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে শুল্কবৃদ্ধি এখন শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার একটি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ