
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আসন্ন নভেম্বর মাসে গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি, ভবিষ্যৎ সংসদ নির্বাচনে প্রচলিত সরাসরি ভোটের (ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট) পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক (Proportional Representation - PR) পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি রাখার আহ্বান জানিয়েছে দলটি।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও অন্যান্য কমিশনারদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষে এসব দাবি উত্থাপন করেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। বৈঠকে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির শীর্ষ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত হয়ে সৈয়দ তাহের বলেন, “আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অত্যন্ত ইতিবাচক আলোচনায় অংশ নিয়েছি। আলোচনায় মূলত তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে—প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার, ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিতের উপায়, এবং নির্বাচনী পদ্ধতির সংস্কার। একই সঙ্গে আমরা নভেম্বর মাসেই গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছি।”
প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণের দাবি
জামায়াত নেতা বলেন, “আমরা প্রবাসী ভোটারদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি। অনেক প্রবাসী ভাই-বোনের এনআইডি নেই, কিন্তু জন্মসনদ আছে। ইসি জানিয়েছে, জন্মসনদ দিয়েও প্রবাসীরা ভোটার হতে পারবেন এবং ভোট দিতে পারবেন। আমরা এতে সন্তুষ্ট। প্রবাসীদের এই সুযোগ দেওয়া হলে বিদেশে অবস্থানরত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি নাগরিক জাতীয় প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন।”
তিনি আরও বলেন, “ভোটার তালিকা হালনাগাদে এনআইডির ভিত্তিতে ভোট নেওয়া হলে জাল ভোট রোধ করা সম্ভব হবে। আমরা এনআইডি সংযুক্ত ভোটার তালিকা এবং ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়েছি। নির্বাচন কমিশনও সে বিষয়ে আমাদের ইতিবাচক আশ্বাস দিয়েছে।”
সংখ্যানুপাতিক (PR) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি
বৈঠকে আলোচনার অন্যতম মূল বিষয় ছিল সংখ্যানুপাতিক ভোট পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল জাতীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতে সংসদীয় আসন পায়।
সৈয়দ তাহের বলেন, “আমরা বলেছি, ৫৪ বছরে প্রচলিত পদ্ধতিতে কোনো নির্বাচনই প্রকৃত অর্থে সুষ্ঠু হয়নি। এই পদ্ধতিতে দিনের ভোট রাতে হয়, কেন্দ্র দখল হয়, প্রশাসনের প্রভাব পড়ে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে জনগণের ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে এবং প্রতিটি ভোটের মূল্য থাকবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমরা নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, তারা যেন দুই ধরনের প্রস্তুতি রাখে—বর্তমান পদ্ধতির পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক ভোটের প্রস্তুতিও থাকুক। যদি রাজনৈতিক ঐক্যমতের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে কমিশন যেন বিলম্ব না করে বাস্তবায়নে সক্ষম হয়।”
গণভোট নিয়ে জামায়াতের অবস্থান
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির বলেন, “গণভোট নিয়ে এখন দুটি প্রস্তাব আলোচনায় আছে। একটি হচ্ছে সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন—এই দুই বিষয়ে একসঙ্গে গণভোট আয়োজন করা। কিন্তু আমরা মনে করি, বিষয় দুটি আলাদা। সংসদ নির্বাচন একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, আর জুলাই সনদ বাস্তবায়ন একটি নীতিগত গণপ্রশ্ন। তাই আমরা বলেছি, গণভোট যেন আলাদাভাবে হয় এবং নভেম্বরেই করা যায় সে প্রস্তুতি নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি সংসদ নির্বাচন আর গণভোট একসঙ্গে হয়, তাহলে দলগুলো নির্বাচনে জয়ের বিষয়েই বেশি মনোযোগ দেবে। এতে গণভোটের মূল বিষয়টি গুরুত্ব হারাবে। আর যেখানে ভোট দখলের সম্ভাবনা থাকে, সেখানেও গণভোট প্রভাবিত হতে পারে। এজন্য আমরা বলেছি—এটা আলাদা আয়োজন হিসেবে করা হোক।”
ব্যয়ের প্রশ্নে জামায়াতের যুক্তি
গণভোট আলাদাভাবে করলে ব্যয় বেড়ে যাবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের এই নেতা বলেন, “গণভোট আলাদা করে করলেই যে ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে, তা নয়। ব্যালট বাক্স তো একই থাকবে, শুধু ব্যালট পেপার আলাদা হবে। খাবারদাবার, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কিছু খরচ হয়তো বাড়বে, কিন্তু সেটি তুলনামূলকভাবে সামান্য। আমরা মনে করি, গণতন্ত্রে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো ব্যয়ের বিষয় নয়, এটি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ।”
রিটার্নিং অফিসার নিয়োগে লটারির প্রস্তাব
বৈঠকে নির্বাচনকালীন প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে জামায়াত আরও কিছু প্রস্তাব দিয়েছে। সৈয়দ তাহের বলেন, “আমরা রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার দাবি জানিয়েছি। প্রস্তাব দিয়েছি যেন লটারির মাধ্যমে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ করা হয়, যাতে কোনো ধরনের পক্ষপাত বা রাজনৈতিক প্রভাব না পড়ে। সরকার ইতোমধ্যে বলেছে তারা এভাবেই করবে, কিন্তু আমরা জোর দিয়েছি যেন সেটা বাস্তবায়িত হয় এবং কমিশন যেন তা নিজ তত্ত্বাবধানে রাখে।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হওয়ার পর নির্বাচন প্রশাসন পুরোপুরি কমিশনের অধীনে চলে আসবে। তাই আমরা অনুরোধ করেছি, কমিশন যেন তখনও একই স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। যাতে জনগণ বিশ্বাস করতে পারে—এই নির্বাচন সত্যিই নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে।”
জামায়াতের বার্তা
বৈঠকের শেষে জামায়াতের পক্ষ থেকে কমিশনকে জানানো হয়, “দেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সব রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের সমন্বিত ভূমিকা দরকার। আমরা চাই নির্বাচন কমিশন তার সাংবিধানিক দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালন করুক। ভোট যেন রাতের অন্ধকারে নয়, দিনের আলোয় জনগণের উপস্থিতিতে হয়—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”
জামায়াতের এ প্রস্তাবের মাধ্যমে আসন্ন সংসদ নির্বাচন ও গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে, নভেম্বরেই গণভোট আয়োজনের এই প্রস্তাব সরকারের বর্তমান প্রস্তুতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ—সেটিই এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ