
ছবি: সংগৃহীত
ইসরায়েলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় নতুন করে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ সংঘাত। এবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও গাজার অন্যতম প্রভাবশালী স্থানীয় দুঘমুশ পরিবারের মধ্যে। সপ্তাহান্তে তেল আল-হাওয়া এলাকায় দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র গোলাগুলিতে কমপক্ষে ২৭ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন আটজন হামাস সদস্য ও দুঘমুশ পরিবারের অন্তত ১৯ জন সশস্ত্র ব্যক্তি।
এই সংঘর্ষকে পর্যবেক্ষকরা গাজার সাম্প্রতিক ইতিহাসে ইসরায়েলি হামলার পর সবচেয়ে ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ সহিংসতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এমন এক সময় এ ঘটনা ঘটল, যখন গোটা উপত্যকা এখনও যুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে।
হামাসের নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, শনিবার রাতে দক্ষিণ গাজার জর্ডানিয়ান হাসপাতালের কাছাকাছি একটি এলাকায় তাদের নিরাপত্তা বাহিনী স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ঘিরে ফেলে। অভিযানটি শুরু হয় যখন হামাস জানতে পারে, দুঘমুশ পরিবারের কয়েকজন অস্ত্রধারী ‘প্রতিরোধ কাঠামোর বাইরে’ নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি মিলিশিয়া ইউনিট গড়ে তুলেছে।
অভিযান শুরু হতেই ভয়াবহ গোলাগুলিতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পুরো এলাকা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, তেল আল-হাওয়া অঞ্চলে অন্তত ৩০০ জনের বেশি হামাস যোদ্ধা অংশ নেয় এই অভিযানে। তারা দুঘমুশ পরিবারের সদস্যদের অবস্থান করা একটি আবাসিক ভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে উভয়পক্ষে ব্যাপক গুলিবিনিময় হয়।
একজন বাসিন্দা বলেন, “আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ইসরায়েলি বাহিনী হয়তো আবার আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু পরে বুঝি, এবার আমরা নিজেদের লোকদের গুলির মুখে পড়েছি।”
স্থানীয় চিকিৎসা সূত্র ও গাজা হাসপাতালের কর্মকর্তাদের মতে, সংঘর্ষে অন্তত ২৭ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে আটজন হামাস যোদ্ধা এবং দুঘমুশ পরিবারের ১৯ সদস্য রয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অনেকে, যাদের বেশিরভাগকে গাজার জর্ডানিয়ান ও আশপাশের ছোট ছোট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
রাতভর চলা গোলাগুলিতে আতঙ্কে শত শত মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। অনেক পরিবার যুদ্ধকালীন সময়ে একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর আবারও ঘর ছেড়ে আশ্রয় নেয় অন্যত্র। স্থানীয়দের ভাষায়, “এবার মানুষ ইসরায়েলি বোমা থেকে পালাচ্ছিল না, তারা নিজেদের ভাইদের গুলির হাত থেকে বাঁচতে দৌড়াচ্ছিল।”
হামাসের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী বর্তমানে “শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের পথে” রয়েছে এবং পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। এক বিবৃতিতে তারা সতর্ক করেছে, “প্রতিরোধ কাঠামোর বাইরে যে কোনো সশস্ত্র কার্যকলাপ কঠোরভাবে দমন করা হবে। যারা জনগণের নিরাপত্তা বিপন্ন করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে হামাস একই সঙ্গে দাবি করেছে, সংঘর্ষের সূত্রপাত দুঘমুশ বন্দুকধারীদের হামলার কারণে। তাদের বক্তব্যে বলা হয়, দুঘমুশ পরিবারের সদস্যরা প্রথমে হামাসের দুই যোদ্ধাকে হত্যা করে ও আরও পাঁচজনকে আহত করে, এরপর হামাস পাল্টা অভিযান চালায়।
অন্যদিকে দুঘমুশ পরিবারের এক জ্যেষ্ঠ সদস্য স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, হামাস বাহিনী একটি ভবনে অভিযান চালায় যা একসময় জর্ডান হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তিনি জানান, “ইসরায়েলি হামলায় আমাদের আল-সাবরা এলাকার বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আমরা এই ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু হামাস আমাদের উচ্ছেদ করে সেখানে তাদের নতুন ঘাঁটি স্থাপন করতে চেয়েছিল। আমরা তা প্রতিহত করার চেষ্টা করি, তখনই গুলিবিনিময় শুরু হয়।”
পরিবারটির অভিযোগ, হামাস প্রশাসন গাজায় নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর অস্তিত্ব মেনে নিতে পারছে না।
দুঘমুশ পরিবার গাজার অন্যতম প্রভাবশালী গোত্র। দীর্ঘদিন ধরেই তাদের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিবারটি গাজা শহরে নিজেদের আধিপত্য ও স্বশাসন বজায় রাখতে চায়, যা হামাসের কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতীতে দুঘমুশ পরিবারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে একাধিকবার গাজায় অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ব্যক্তিগত প্রতিশোধমূলক হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
২০০৭ সালের দিকে, যখন হামাস গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখনও এই পরিবারের সঙ্গে তাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল, যাতে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়।
ইসরায়েলি অবরোধে থাকা গাজার জনগণ এই ঘটনার পর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা, অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও গোত্রভিত্তিক প্রতিশোধের রাজনীতি গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
একজন বয়স্ক বাসিন্দা বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ইসরায়েলি ট্যাংক ও বিমান হামলার ভয় পেয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাসই আমাদের শেষ করে দেবে।”
বর্তমানে হামাসের নিরাপত্তা ইউনিটগুলো তেল আল-হাওয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় টহল দিচ্ছে। শহরে কারফিউসদৃশ পরিবেশ বিরাজ করছে। অনেক এলাকা এখনও বিদ্যুৎহীন, এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো থেকে মৃতদেহ উদ্ধারের কাজ চলছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, “আমরা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনেছি। যারা আইন ভঙ্গ করবে বা প্রতিরোধ কাঠামোর বাইরে কাজ করবে, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।”
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংঘর্ষ হামাসের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জকেই উন্মোচন করে দিয়েছে। গাজায় দীর্ঘমেয়াদি ইসরায়েলি অবরোধ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে স্থানীয় গোত্র ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বেড়ে গেছে, যা হামাসের কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের জন্য নতুন মাথাব্যথা হয়ে উঠছে।
এক বিশ্লেষক বলেন, “হামাস এখন শুধু ইসরায়েলের সামরিক হামলার মুখোমুখি নয়, বরং নিজেদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ধরে রাখাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
গাজায় হামাস ও দুঘমুশ পরিবারের সংঘর্ষ শুধু ২৭টি প্রাণই কেড়ে নেয়নি—এটি গাজা সমাজের ভেতরের গভীর ক্ষত ও বিভাজনকেও উন্মোচন করেছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই ভূখণ্ডে যখন প্রতিটি পরিবার ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর বেঁচে থাকার লড়াই করছে, তখন নিজেদের মধ্যে এমন সহিংসতা গাজার ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে।
একজন হতভম্ব স্থানীয় বাসিন্দার ভাষায়, “আমরা ভাবতাম, সবচেয়ে বড় শত্রু সীমান্তের ওপারে। এখন দেখছি, আমাদের ঘরেই সেই যুদ্ধের আগুন।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ