
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী প্রস্তুতি এখন তুঙ্গে। এমন এক সময়ে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্থগিত, ভোটের মাঠে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত করেছেন, নির্বাচনের আগেই তিনি দেশে ফিরবেন এবং সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেবেন। বিএনপি ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে প্রার্থী বাছাই, তৃণমূল পর্যায়ে সভা-সমাবেশ এবং ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের পক্ষে গণসংযোগ শুরু করেছে মাসখানেক আগে। দলের কার্যক্রম মূলত: উঠান বৈঠক, লিফলেট বিতরণ, নির্বাচনী প্রচারণা এবং কর্মী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৃণমূলের ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর ওপর কেন্দ্রীভূত।
উল্লাপাড়ার উদাহরণ দেখাচ্ছে, ছোট্ট গ্রামে অন্তত পঞ্চাশেক বিএনপি কর্মী অংশগ্রহণে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে একত্রিশ দফা সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করা হয় এবং দলের প্রতি ও ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। তবে এই আসনে এখনও দলের চূড়ান্ত প্রার্থী নির্ধারিত হয়নি, এবং অন্তত ছয়জন সম্ভাব্য প্রার্থী মাঠে রয়েছেন।
এদিকে বিএনপির প্রধান প্রার্থী হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। উল্লাপাড়া পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, দল প্রতি ইউনিয়ন ও গ্রামে উঠান বৈঠক এবং গণসংযোগের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। যদিও প্রচারণা কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে, কিন্তু সম্ভাব্য প্রার্থীরা ধানের শীষের পক্ষে কাজ চালাচ্ছেন, ফলে দলের জন্য তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
তবে নির্বাচনী ময়দানে জামায়াতে ইসলামীও পিছিয়ে নেই। দলটি প্রার্থীদের নির্ধারণ ও প্রস্তুতি শুরু করেছে প্রায় এক বছর আগে। উল্লাপাড়ার করতোয়া নদীর পাড়ে নৌকাবাইচ এবং সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা হচ্ছে। উপজেলার জামায়াতের উপজেলা আমীর শাহজাহান আলী জানান, প্রতিটি ঘরে ঘরে দলের প্রচারণা পৌঁছে গেছে। সামাজিক কাজ, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও দলীয় প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রার্থী জনগণের কাছে পৌঁছেছেন। ভোটের জন্য এজেন্ট নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণের কাজও প্রায় শেষের পথে।
জামায়াতের নেতা ও কর্মীরা মনে করছেন, তাদের প্রার্থী নির্বাচিত ও প্রস্তুত, আর বিএনপি এখনও চূড়ান্ত প্রার্থী নির্ধারণ করতে পারেনি। এই অবস্থায় জামায়াত মনে করছে তাদের অবস্থান নির্বাচনে জেতার মতো শক্তিশালী। উল্লাপাড়া উপজেলা জামায়াত আমীর শাহজাহান আলী আত্মবিশ্বাসীভাবে বলেন, “আমরা শুধু জিতবো না, দুই-তৃতীয়াংশ আসনে ইনশাআল্লাহ জয়ী হবো।”
জামায়াতের এই আত্মবিশ্বাসের পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে:
১. প্রার্থী নিশ্চিত করা: জামায়াত তাদের প্রার্থী আগেভাগেই নির্ধারণ করেছে।
২. বিএনপির নেতৃত্ব ও চাঁদাবাজি: বিএনপির অতীতের কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে ভোটাররা তাদের থেকে মুখ ফিরিয়েছেন।
৩. ভোটারদের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভোটার পরিবর্তন চায়।
বিএনপি তবে এসব মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করছে। দলটির উল্লাপাড়া পৌর আহ্বায়ক বলেন, উল্লাপাড়া বিএনপির ঘাঁটি। এখানে জামায়াত কখনই বিএনপির ভোট কেটে নিতে পারবে না। কারণ, মূল প্রার্থীরা ধানের শীষের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন এবং দলীয় একতা বজায় রয়েছে।
সোনতলা ব্রিজ এলাকার সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ এখন অনুপস্থিত, তাই নির্বাচনে বিএনপি এবং জামায়াত মুখোমুখি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। মুদি দোকানদার জামান মিয়া বলেন, “আওয়ামী লীগ তো এখন নেই। কিন্তু বিএনপি আর জামায়াতের মধ্যে লড়াই হবে।”
আব্দুল হাকিম জানান, দুই দলের কর্মীরা সরাসরি ভোটারদের কাছে পৌঁছাচ্ছেন। স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটাররা ভোট দেবেন তাদেরই, যারা নিরাপদ মনে করবেন।
সিরাজগঞ্জে ছয়টি সংসদীয় আসন আছে। এখানকার নির্বাচন মূলত বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষপূর্ণ। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগের ভোটাররা কোনো নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন না করলে, তা ভোটের ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি অমর কৃষ্ণ দাস বলেন, “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটাররা বিএনপিকে সমর্থন করবেন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সব দল রাজনীতি করার সুযোগ পাবে।”
জামায়াত অবশ্য মনে করে, তাদের চ্যালেঞ্জিং অবস্থান রয়েছে। দলের উল্লাপাড়া উপজেলা আমীর বলেন, “কিছু সংখ্যক আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটার হয়তো ভোট দিতে পারেন না। তবে অধিকাংশ ভোটার আমাদেরকে ভোট দেবেন, কারণ তারা নিরাপদ মনে করেন।”
উল্লাপাড়া ও সিরাজগঞ্জের নির্বাচনী মাঠে বিএনপি ও জামায়াত সক্রিয়। বিএনপি ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে গণসংযোগ ও তৃণমূল সভা-সমাবেশ চালাচ্ছে, যেখানে এখনও চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়াধীন। অন্যদিকে জামায়াত প্রার্থী নির্ধারণ ও প্রস্তুত অবস্থায়, সরাসরি ভোটারদের কাছে পৌঁছাচ্ছে এবং নৌকাবাইচ, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও সাংস্কৃতিক প্রচারণার মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি শক্তিশালী করছে। তবে ভোটের চূড়ান্ত ফল নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটারদের মনোভাবের উপর, যারা ভোটে অংশ নেবেন কিনা এবং কোন দলকে সমর্থন করবেন।
সার্বিকভাবে, নির্বাচনী ময়দানে দুই দলই নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান প্রমাণ করার চেষ্টা করছে, যেখানে ভোটারের নিরাপত্তা, জনপ্রিয়তা এবং তৃণমূল কার্যক্রম তাদের জয়ের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ