
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে মানবাধিকার রক্ষায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে সরকার প্রণয়ন করেছে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫’-এর খসড়া, যেখানে প্রথমবারের মতো কমিশনকে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এটি ২০০৯ সালের বিদ্যমান আইন রহিত করে একটি শক্তিশালী, স্বাধীন ও বিকেন্দ্রীকৃত মানবাধিকার কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই প্রণীত হচ্ছে।
আগের ২০০৯ সালের আইনে কমিশনের ওপর সরকারের নির্বাহী বিভাগের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল; কমিশন সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারত না। নতুন খসড়া আইনে এই সীমাবদ্ধতা সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হয়েছে। এখন থেকে কমিশন সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে, এমনকি কারাগার, হেফাজতকেন্দ্র, সংশোধনাগার বা আটকস্থল পরিদর্শনের ক্ষমতাও পাবে।
আইনের ১৩তম ধারায় বলা হয়েছে, কমিশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বা অভিযোগের ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত করতে পারবে। রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থার অবহেলা, প্ররোচনা বা প্রতিরোধে ব্যর্থতার ঘটনাও কমিশনের অনুসন্ধানের আওতায় আসবে। এছাড়া কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তির চিকিৎসা, পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণ ও আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে পারবে।
নতুন আইনে কমিশনের গঠনেও বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আগে কমিশনে তিনজন সদস্য থাকলেও এখন সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারী ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে। সদস্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও স্বাধীন রাখতে একটি পৃথক বাছাই কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।
এই কমিটিতে থাকবে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গণবিজ্ঞপ্তি, সাক্ষাৎকার ও যোগ্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে—যা অতীতে সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না।
২০০৯ সালের আইনে কমিশনের বাজেট পাঠাতে হতো মন্ত্রণালয়ে, যেখানে অনেক সময় কাটছাঁট করা হতো। এখন নতুন আইনে কমিশনকে নির্বাচন কমিশনের মতো স্বাধীন সংযুক্ত তহবিল থেকে সরাসরি অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। কমিশনের ব্যয়কে রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক দায় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে কার্যক্রমে কোনো আর্থিক বাধা সৃষ্টি না হয়।
কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি চাকরিজীবীদের সমপর্যায়ের বেতন, পেনশন ও গ্র্যাচুইটি সুবিধা দেওয়ার বিধানও যুক্ত হয়েছে। এর ফলে দক্ষ জনবল ধরে রাখা ও কমিশনের পেশাগত মান বাড়ানোর পথ খুলবে।
আগের আইন অনুযায়ী কমিশনের কার্যক্রম ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। এবার প্রস্তাব করা হয়েছে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিশনের শাখা বিস্তৃত করার, যাতে সাধারণ মানুষ সহজে অভিযোগ দাখিল ও সুরক্ষা পেতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ের মানবাধিকার সংরক্ষণে এই পদক্ষেপকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
খসড়া আইনের ১৫ নম্বর ধারায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ দাখিল ও প্রতিকার পাওয়ার বিস্তারিত প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা হয়েছে।
-
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার পক্ষে অন্য কেউ বিনা ফি’তে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন।
-
অভিযোগ লিখিত, মৌখিক বা নির্ধারিত অন্য মাধ্যমে করা যাবে।
-
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগ করতে হবে; তবে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে বিলম্ব ক্ষমা করা হবে।
-
অভিযোগ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে কমিশন প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করবে।
-
অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে কমিশন শুনানির তারিখ নির্ধারণ করবে।
যদি অভিযোগ কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে পড়ে, তবে কমিশন তা সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠাবে এবং অভিযোগকারীকে সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দেবে। আর যদি অভিযোগ কমিশনের এখতিয়ারে পড়ে, তবে কমিশন নিজেই ক্ষতিপূরণ, জরিমানা বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুই মাসের মধ্যে কমিশনের আদেশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
আগের আইনে সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা ছিল — শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে তদন্তে নিষেধাজ্ঞা। নতুন আইনে সেই সীমাবদ্ধতা সম্পূর্ণভাবে তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে র্যাব, পুলিশ বা অন্য কোনো নিরাপত্তা সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এখন কমিশন সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবে।
নতুন আইনে কমিশনকে মানবাধিকার বিষয়ে গবেষণা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিশন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলের সঙ্গে দেশের আইন ও নীতিমালার সামঞ্জস্য যাচাই, প্রয়োজনীয় সংশোধন প্রস্তাব ও নতুন চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শ দেবে।
এছাড়া মানবাধিকারবিষয়ক মামলায় কমিশন চাইলে আদালতে পক্ষ হিসেবেও অংশ নিতে পারবে। এনজিও, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ে কমিশন একটি কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও কাজ করবে।
জাতীয় পরামর্শ সভায় অংশ নিয়ে উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “দেশের মানুষের জন্য শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন অপরিহার্য। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে স্বাধীন কমিশন তৈরি করতে না পারি, তাহলে রাষ্ট্রের জবাবদিহি ব্যাহত হবে। আওয়ামী লীগের আমলে মানবাধিকার রক্ষার পরিবর্তে গুম, খুন ও নির্যাতনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। বর্তমান সরকার যদি এই আইনের মাধ্যমে বাস্তব স্বাধীনতা দেয়, তবে এটি হবে মানবাধিকার রক্ষায় একটি মাইলফলক।”
বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশন প্রথম গঠিত হয় ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, আর কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালের ১৪ জুলাই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন পাস করে। তবে গত এক যুগে কমিশন কার্যত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকায় এর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
তৎকালীন সরকার দলীয় অনুগতদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে নিয়োগ দিয়ে কমিশনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। এর ফলে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় কমিশন নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
বর্তমান সরকার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) অধ্যাদেশের খসড়া উন্মোচন করে। আইন মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই পরামর্শ সভায় তিনজন উপদেষ্টা, অ্যাটর্নি জেনারেল, আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
আইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা মনে করেন, প্রস্তাবিত ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ-২০২৫’ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ মানবাধিকার সুরক্ষায় একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। এটি জাতিসংঘ মানবাধিকার চুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, যা দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাকে আরও জোরদার করবে।
এই আইনের মাধ্যমে কমিশন শুধুমাত্র তদারকি সংস্থা নয়, বরং একটি শক্তিশালী আইনগত ও প্রশাসনিক ক্ষমতাসম্পন্ন স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে—যা মানবাধিকার রক্ষার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ