
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ব্যর্থতার গল্প যেন ক্রমেই এক গভীর হতাশার প্রতীক হয়ে উঠছে। এক সময় ওয়ানডেতে বিশ্বের যেকোনো দলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা দেখানো দলটি এখন যেন নিজস্ব সীমাবদ্ধতার ভেতরেই হারিয়ে যাচ্ছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাত্র ১৯১ রানের সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে এমন এক ব্যাটিং বিপর্যয় ঘটেছে, যা দীর্ঘদিন মনে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে।
২৪ ওভারের মধ্যেই ১০০ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। শেষ ৫ উইকেট যায় মাত্র ১০ রানে। ১০৯ রানে অলআউট হয়ে ৮১ রানের বড় ব্যবধানে হেরে সিরিজটাও আফগানিস্তানের হাতে তুলে দেয় মেহেদী হাসান মিরাজের দল।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে টিকে থাকার ম্যাচটি শুরু থেকেই যেন এক অদ্ভুত মানসিক চাপের প্রতিচ্ছবি ছিল। মাত্র ১৯১ রানের লক্ষ্য তাড়ায় নামা বাংলাদেশের ইনিংসের প্রথম বলেই ভরাডুবির ইঙ্গিত মেলে।
আজমতউল্লাহ ওমরজাইয়ের প্রথম ওভারেই ফাইন লেগে বশির আহমেদের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ওপেনার তানজিদ হাসান তামিম। তার বিদায়ের পরই দলটা যেন আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সাইফ হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্ত কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করলেও বড় জুটি গড়া হয়নি।
২৫ রানে রানআউট হন শান্ত। পরের উইকেটে ৪০ রানে ওমরজাইয়ের বলে থার্ডম্যানের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে বিদায় নেন সাইফ হাসান।
ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান মিরাজ-এর ওপর ছিল অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু তিনিও নিজের দায়িত্বটুকু পালন করতে পারলেন না। ওমরজাইয়ের বলেই এলবিডব্লু হয়ে ফেরেন তিনি, রিভিউ নিয়েও রক্ষা পাননি। স্কোরবোর্ডে তখন বাংলাদেশের রান মাত্র ৫০, আর চতুর্থ উইকেট পতন।
এরপর কিছুটা ভরসা জাগান তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলী। দুজনের ব্যাটে ২৯ রানের জুটি তৈরি হলেও সেটিও টিকেনি বেশিক্ষণ। দলের সংগ্রহ যখন ৭৯, তখন রশিদ খানের চাতুর্যে বোল্ড হয়ে ফেরেন তাওহিদ হৃদয় (২৪)।
৫ উইকেটে ৯৯ রানে বাংলাদেশ তখনও ম্যাচে টিকে ছিল। দরকার ছিল আর ৯১ রান, হাতে ৫ উইকেট ও প্রচুর ওভার। কিন্তু এই অবস্থান থেকে হঠাৎই শুরু হয় এক অকল্পনীয় পতন।
৯৯ রানে উইকেট হারানোর সেই মূহূর্তে যেন থেমে যায় বাংলাদেশের লড়াই। নুরুল হাসান সোহান সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হন। তার পরের বলেই এলবিডব্লু হয়ে ফেরেন তানজিম হাসান সাকিব।
তারপর আসে পরপর ধাক্কা—নানগেয়ালিয়া খারোতির বলে জাকের আলী অনিক শর্ট কাভারে রশিদ খানের হাতে ধরা পড়েন। ৯৯ রানে তখন বাংলাদেশের ৮ উইকেট শেষ।
দল শতরান অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই (১০০/৯) ফেরেন তানভির ইসলাম। শেষ দিকে রিশাদ হোসেন কিছুটা লড়াই করার চেষ্টা করেন মোস্তাফিজুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। আফগান স্পিনারদের ঘূর্ণিতে শেষ পর্যন্ত ১০৯ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস।
এর আগে টস জিতে ব্যাটিং নেয় আফগানিস্তান। কিন্তু শুরুটা তাদেরও খুব একটা ভালো ছিল না। তবু একজন ব্যাটার পুরো ইনিংসের ভরসা হয়ে দাঁড়ান—ইব্রাহিম জাদরান।
তিনি খেলেন ১৪০ বলের ধৈর্যশীল ইনিংস, যেখানে ছিল মাত্র ৩টি চার ও ১টি ছক্কা। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৫ রান দূরে থাকতেই মেহেদী মিরাজের বলে রিশাদ হোসেনের হাতে ক্যাচ তুলে দেন তিনি।
জাদরানের ব্যাটেই আফগানিস্তান গড়ে ১৯০ রানের সংগ্রহ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২ রান করে যৌথভাবে অবস্থান করেন মোহাম্মদ নবী ও মোহাম্মদ গজনফর।
বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে সফল বোলার ছিলেন অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ — ১০ ওভারে ৩ উইকেট নেন ৩৫ রানে। এছাড়া রিশাদ হোসেন ও তানজিম হাসান সাকিব পান ২টি করে উইকেট, তানভির ইসলাম নেন ১টি।
আফগানিস্তানের ইনিংস শেষে অনেকেই মনে করেছিলেন, ১৯১ রানের এই লক্ষ্য বাংলাদেশের জন্য খুব একটা কঠিন হবে না। কারণ এই মাঠে এমন রান সাধারণত প্রথম ৩০ ওভারেই তুলে ফেলে বাংলাদেশের টপ অর্ডার। কিন্তু আজ সেই টপ অর্ডারই যেন নিজের ছায়া হয়ে গেল।
একদিকে আফগান স্পিনাররা নিয়ন্ত্রণে রাখেন লাইন-লেংথ, অন্যদিকে বাংলাদেশের ব্যাটাররা একের পর এক অযৌক্তিক শট খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দেন। উইকেটের ধারে স্লিপ ফিল্ডার, মিড উইকেটে ফাঁদ, পয়েন্টে আগানো ফিল্ডার—সবই কাজে লাগায় আফগান অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শাহিদি।
শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান ৮১ রানের বিশাল ব্যবধানে জিতে নেয় ম্যাচ ও সিরিজ দুটোই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যর্থতা শুধুমাত্র ব্যাটিং নয়, বরং মানসিক দৃঢ়তার অভাব এবং গেম প্ল্যানের দুর্বলতা। ১৯১ রানের মতো সহজ লক্ষ্য তাড়ায়ও দলটি যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল।
ক্রীড়া বিশ্লেষক রফিকুল ইসলাম মনে করেন— “এটি শুধুই একটি হার নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ব্যাটিং মনস্তত্ত্বের গভীর সংকটের প্রতিফলন। একজন সেট ব্যাটারও ইনিংস দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। এমন উইকেটে ১৯১ রান তাড়া না করা অগ্রহণযোগ্য।”
অন্যদিকে সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার বলেছেন— “স্পিনারদের বিপক্ষে খেলতে আমাদের ব্যাটারদের টেকনিক্যাল সমস্যা স্পষ্ট। কেউই পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে পারেননি। আফগানিস্তানের স্পিন আক্রমণ আগেও আমাদের ভুগিয়েছে, এবার সেটাই আবার হলো।”
সিরিজে টিকে থাকার জন্য এই ম্যাচে জয়ের কোনো বিকল্প ছিল না বাংলাদেশের সামনে। কিন্তু তা না পারায় ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হার নিশ্চিত হয়। এখন তৃতীয় ম্যাচ শুধু আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই মাঠে নামবে মিরাজের দল।
বাংলাদেশ দলের ভেতরে এখন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—এমন বিপর্যয় কেন বারবার ঘটছে? নেতৃত্ব, টিম সিলেকশন, মানসিকতা—সবকিছু নিয়েই সমালোচনার ঝড় বইছে ক্রিকেট অঙ্গনে।
এক সময় ওয়ানডেতে বিশ্বে মধ্যম সারির শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু আফগানিস্তানের মতো তুলনামূলক নবীন দলের বিপক্ষে এমন লজ্জাজনক পারফরম্যান্স এখন দলের মনোবল ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা—দুটোকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই পরাজয় শুধু একটি সিরিজ হার নয়; এটি বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। ১৯১ রানের লক্ষ্যও এখন যদি পার হতে না পারে, তবে উন্নতির স্বপ্ন কেবলই মুখের বুলি।
বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা এখন যে প্রশ্নের মুখে—“আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে?” তার উত্তর খুঁজে পেতে হলে প্রয়োজন মৌলিক পরিবর্তন—মানসিকতা, কৌশল ও আত্মবিশ্বাসের জায়গায়। অন্যথায় এমন লজ্জার হারই হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের নতুন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ