
ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান দুই দিন পিছিয়েছে। পূর্বনির্ধারিত ১৫ অক্টোবর, বুধবারের পরিবর্তে এখন এই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে ১৭ অক্টোবর, শুক্রবার বিকেলে। জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত এই অনুষ্ঠানের সময়সূচি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে—যাতে বেশি সংখ্যক নাগরিক প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থাকতে পারেন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে।
শনিবার (১১ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি দেশের জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে চায় সরকার ও কমিশন—সেই উদ্দেশ্যেই শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিনকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
জুলাই জাতীয় সনদকে অনেকেই দেশের চলমান রাজনৈতিক রূপান্তরের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দেখছেন। এই সনদের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের বিভাজন দূর করার লক্ষ্যে একটি নতুন ঐকমত্য গড়ে তোলা হচ্ছে। সনদটি হবে ভবিষ্যৎ সরকারের কার্যপথ ও রাজনৈতিক সংস্কারের দিকনির্দেশনা হিসেবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “এই সনদ শুধু একটি দলিল নয়, এটি বাংলাদেশের নতুন সূচনার ঘোষণা। তাই জনগণকে সরাসরি যুক্ত করা হচ্ছে—যাতে এই পরিবর্তনের মালিকানা শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের নয়, বরং সাধারণ মানুষের হয়।”
বৈঠক শেষে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের জানান, মূলত জনগণের উপস্থিতি নিশ্চিত করতেই এই পরিবর্তন। তিনি বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। আমরা চাই, দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই মুহূর্তের সাক্ষী হোক। তাই সপ্তাহের মাঝের দিন না রেখে শুক্রবারে অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তিনি আরও জানান, অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়, যা ঐতিহ্য, প্রতীক এবং গণতান্ত্রিক ঐক্যের প্রতিচ্ছবি বহন করে। সেখানে উপস্থিত থাকবেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিজন, নাগরিক সমাজের নেতারা, তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রবাসী প্রতিনিধিরাও।
শনিবারের বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একাধিক সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। বৈঠকে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটিকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রদানের বিষয়ে আলোচনা হয়।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “এই সনদের মাধ্যমে আমরা এমন এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা করতে চাই, যেখানে পারস্পরিক সম্মান ও জবাবদিহিতা থাকবে। সনদটি কেবল দলীয় নয়—এটি হবে জনগণের সার্বিক মতৈক্যের প্রতিফলন।”
অন্যদিকে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানান, অনুষ্ঠানটিতে থাকবে সংস্কৃতিমূলক পরিবেশনা, নাগরিক অঙ্গীকার পাঠ এবং সম্মিলিত সঙ্গীত—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ঐক্য ও আশার বার্তা ছড়িয়ে দেবে।
এর আগে কমিশন থেকে জানানো হয়েছিল যে, ১৫ অক্টোবর বুধবার বিকেলে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হবে। সে সময় অনুষ্ঠানের সম্ভাব্য স্থান হিসেবে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণকেই প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে নতুন সিদ্ধান্তে সেই তারিখ দুই দিন পেছানো হলো, যাতে কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষ—যাঁরা সপ্তাহের মাঝের দিনে উপস্থিত হতে পারতেন না—তাঁরাও অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারেন।
জুলাই জাতীয় সনদকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিমধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এটি মূলত একটি নতুন জাতীয় চুক্তি, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা ও নীতিনির্ধারণের দিক নির্দেশ করা হবে। সনদে গণতান্ত্রিক সংস্কার, দুর্নীতি দমন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা সম্পর্কিত মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “এটি হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭২ সালের সংবিধানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যদি এর বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হয়, তবে এটি স্থায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে।”
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিতব্য এই অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতির সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা যৌথভাবে কাজ করবে যাতে অনুষ্ঠানটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়। পাশাপাশি অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি গণমাধ্যম।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, সেদিন বিকেল থেকেই সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে থাকবে নাগরিক সম্মেলনের পরিবেশ—বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐক্যের প্রতীকী প্রদর্শনীরও আয়োজন থাকবে।
সবকিছু মিলিয়ে, জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান এখন শুধু একটি প্রশাসনিক বা আনুষ্ঠানিক আয়োজন নয়—এটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নতুন পথচলার প্রতীক। শুক্রবারের অনুষ্ঠানকে ঘিরে রাজধানীসহ সারাদেশে চলছে প্রস্তুতি ও আগ্রহের জোয়ার।
বহু রাজনৈতিক নেতা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এই সনদই হতে পারে বিভক্ত বাংলাদেশকে আবার এক স্রোতে ফেরানোর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
১৭ অক্টোবরের সেই বিকেলটি তাই অপেক্ষায় আছে—বাংলাদেশের নতুন অধ্যায় লেখার সাক্ষী হতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ