
ছবি: সংগৃহীত
ভূমধ্যসাগরের গভীর নীল জলে প্রতিদিনই যেন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন লাশ। পরিসংখ্যানের ঠান্ডা অঙ্কের আড়ালে লুকিয়ে আছে অগণিত পরিবারের কান্না, হারিয়ে যাওয়া যুবক, মায়ের বুকভরা শূন্যতা। সেই মৃত্যুর মিছিলেই শীর্ষে এখন বাংলাদেশের নাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার পর এশিয়া থেকে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের বড় অংশই এসেছে বাংলাদেশ থেকে। ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী সংস্থা ফ্রনটেক্সের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশটি বাংলাদেশের নাগরিক।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ জন মানুষ। যদিও আগের বছরের তুলনায় মোট প্রবেশ ২২ শতাংশ কমেছে, কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থান উল্টো শীর্ষে উঠেছে। শুধু বাংলাদেশ থেকেই চলতি বছর অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন ৫০ হাজার ৮৫০ জন, যা গত বছরের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি। আরও উদ্বেগজনক তথ্য হলো, শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই এই বিপজ্জনক পথে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন ৮ হাজার ৪৬ জন বাংলাদেশি।
মধ্য ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় রুট এখন ইউরোপে অনিয়মিত অভিবাসনের প্রধান পথ হিসেবে পরিচিত। মূলত লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া ও মিসরের উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে এসব নৌকা ইতালির দক্ষিণ উপকূলে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এসব নৌকা বেশিরভাগই ছোট, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই এবং অচলাবস্থার ঝুঁকিতে ভরা। ইউরোপীয় সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে, পুরো ইউরোপে অনিয়মিতভাবে প্রবেশকারীদের প্রায় ৪০ শতাংশই এই রুট দিয়ে প্রবেশ করে।
এ পথের যাত্রা কেবল কঠিন নয়, ভয়ঙ্করও বটে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ১ হাজার ২৯৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেই নিখোঁজ, যাদের সংখ্যা এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। সংগঠনটির এক মুখপাত্র বলেন, “মানুষ এখনো জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও ইউরোপে পৌঁছানোর স্বপ্ন ছাড়ছে না। এটি মানবিক সংকটের এক গভীর উদাহরণ।”
ফ্রনটেক্সের প্রতিবেদন বলছে, কঠোর নজরদারি ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার করায় পশ্চিম আফ্রিকান রুটে অনিয়মিত প্রবেশ ৫৮ শতাংশ, পশ্চিম বলকান রুটে ৪৭ শতাংশ, এবং পূর্ব ইউরোপের স্থলসীমান্ত দিয়ে অবৈধ প্রবেশ ৩৬ শতাংশ কমেছে। কিন্তু বিপরীতে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় রুটে অনিয়মিত প্রবেশ ২৮ শতাংশ বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে এই রুটে প্রবেশের হার ছিল প্রায় দ্বিগুণ, যেখানে আলজেরিয়া থেকে যাত্রা করা অভিবাসীরাই তিন-চতুর্থাংশ।
অন্যদিকে, ফ্রান্স হয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টাও বেড়েছে ১৪ শতাংশ। এই বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৫৪ হাজার ৩০০ জন অভিবাসী ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমের চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে বহু বাংলাদেশিও রয়েছেন বলে ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যমগুলো উল্লেখ করেছে।
বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসনের প্রবণতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বেকারত্ব, দালালচক্রের প্রতারণা ও ইউরোপে সহজ জীবনের কল্পনা। দক্ষিণ ইউরোপের দেশ ইতালি, গ্রীস ও মাল্টা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশিদের কাছে ‘স্বপ্নের গন্তব্য’। কিন্তু এই স্বপ্নের পেছনে দালালচক্র গড়ে তুলেছে এক ভয়াবহ ব্যবসা।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “প্রতিটি বাংলাদেশি পরিবারে এখন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, যার কেউ না কেউ বিদেশে নেই। এই সামাজিক চাপও মানুষকে অবৈধ পথে যেতে উৎসাহিত করে। কিন্তু তারা জানে না, ইউরোপে পৌঁছানো মানেই নিরাপত্তা নয়; বরং অনেক সময় জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে আটকে থাকা।”
অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি নীতিমালা আরও কঠোর করেছে। লিবিয়া ও তিউনিসিয়ার উপকূলরক্ষীদের সহায়তায় নৌ টহল বাড়ানো হয়েছে, এবং অনিয়মিত প্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করা হচ্ছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব পদক্ষেপ মানবিক নয়। ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার কার্যক্রম কমিয়ে দেওয়ার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “মানুষের জীবন রক্ষার বদলে ইউরোপ এখন সীমান্ত রক্ষায় ব্যস্ত। ফলাফল—ভূমধ্যসাগর পরিণত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কবরস্থানে।”
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলো—বিশেষ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলায় প্রায় প্রতিদিনই নতুন করে নিখোঁজ বা মৃত্যুর খবর আসে। ইউরোপে পৌঁছানোর আশায় ঘরবাড়ি বিক্রি করে, ধারদেনা করে যাত্রা শুরু করা অনেক তরুণ আজ নিখোঁজের তালিকায়। তাদের পরিবারগুলোর অনিশ্চয়তা যেন কখনো শেষ হয় না।
একজন নিহত অভিবাসীর ভাই বলেন, “ভাইটা বলেছিল, ইউরোপে গিয়ে কাজ করে সংসারটা টানবে। এখন ওর লাশও পাইনি, শুধু খবর পেয়েছি নৌকা ডুবেছে।”
ফ্রনটেক্স ও আইওএমের পরিসংখ্যান শুধু একটি আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন নয়; এটি একটি জাতির গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়া মানে অজানার পথে জীবনবাজি রাখা। তথাপি বাংলাদেশের অসংখ্য যুবক এখনো সেই মরণযাত্রায় পা বাড়াচ্ছে—স্বপ্নের ইউরোপে পৌঁছানোর আশায়।
এ যেন এক নিঃশব্দ যুদ্ধ, যেখানে গন্তব্য অজানা, বিজয় নেই—শুধু শূন্যতা আর সমুদ্রের গর্জন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ