
ছবি: সংগৃহীত
টি-টোয়েন্টি সিরিজে হোয়াইটওয়াশের তিক্ততা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে আবারও হতাশার মুখ দেখল বাংলাদেশ। আবুধাবির শেখ জায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫ উইকেটের পরাজয় বরণ করতে হলো সাকিববিহীন বাংলাদেশ দলকে। ২২২ রানের সহজ লক্ষ্যে খেলতে নেমে আফগান ব্যাটাররা যেন ক্লিনিক্যাল ব্যাটিংয়ের এক নিখুঁত উদাহরণ স্থাপন করল। ১৭ বল বাকি থাকতেই মোহাম্মদ নবি ছক্কা মেরে জয় নিশ্চিত করেন আফগানদের জন্য।
এদিন টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু শুরু থেকেই ব্যাটিংয়ে ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি। উইকেটের আচরণ ছিল কিছুটা ধীর, বল আসছিল ধীরে, স্পিনারদের টার্ন ছিল যথেষ্ট। কিন্তু আফগান বোলারদের শৃঙ্খলিত বোলিংয়ের বিপরীতে বাংলাদেশের টপ অর্ডার ব্যাটাররা যেন পথ হারিয়ে ফেলেন। ইনিংসের শুরুতে দ্রুত উইকেট হারিয়ে দল পড়ে চাপে। এক পর্যায়ে ৭৫ রানের মধ্যেই ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
তবে সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটু ভরসা জোগান তরুণ তাওহিদ হৃদয় ও অভিজ্ঞ মেহেদী হাসান মিরাজ। এই দুজনের জুটিতেই বাংলাদেশের ইনিংসে আসে কিছুটা স্থিতি। ৮২ রানের গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়ে দলকে ২০০ রানের দিকে নিয়ে যান তারা। তাওহিদ হৃদয় সাবলীলভাবে খেলে ৭৫ বলে ৫৬ রান করেন, যেখানে ছিল ৫টি চমৎকার চার। অন্যদিকে মিরাজ খেলেন ৬০ রানের ধৈর্যশীল ইনিংস, যা ছিল দলের সর্বোচ্চ। কিন্তু তাদের বিদায়ের পর আর কেউ দাঁড়াতে পারেননি। বাকি ব্যাটারদের ব্যর্থতায় ৪৫তম ওভারে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ, সংগ্রহ দাঁড়ায় মাত্র ২২১ রানে।
আফগান বোলারদের মধ্যে সর্বাধিক সফল ছিলেন রশিদ খান ও আজমাতউল্লাহ ওমরজাই। দুজনেই ৩টি করে উইকেট নিয়েছেন। বিশেষ করে রশিদ খান মাঝের ওভারে স্পিনের জাদু দেখিয়ে বাংলাদেশের মিডল অর্ডারকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। তার নিখুঁত গুগলি ও লেগ-ব্রেকের মিশ্রণে বাংলাদেশের ব্যাটাররা ছন্দ হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে, নতুন বলে ওমরজাইয়ের ধারালো সুইং বোলিং বাংলাদেশের ওপেনারদের বিপাকে ফেলে দেয়।
২২২ রানের সহজ টার্গেট তাড়া করতে নেমে আফগানিস্তান শুরু থেকেই ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়। রহমানুল্লাহ গুরবাজ ও ইব্রাহিম জাদরান উদ্বোধনী জুটিতে গড়ে তোলেন ৫২ রান। বাংলাদেশের পেসাররা ভালো লেন্থে বল করতে পারলেও আফগান ব্যাটাররা কোনো তাড়াহুড়ো না করে ধীরস্থিরভাবে ব্যাটিং করেন। পরিকল্পনা ছিল স্পষ্ট—ঝুঁকিহীন ব্যাটিং, সিঙ্গেল-ডাবলের মাধ্যমে স্কোরবোর্ড সচল রাখা, আর সুযোগ পেলে বড় শট নেওয়া।
ইব্রাহিম জাদরান ২৩ রান করে আউট হলে জুটি ভাঙে। এরপর সেদিকুল্লাহ আতাল মাত্র ৫ রান করে ফিরে গেলে কিছুটা চাপ তৈরি হয়। কিন্তু সেই চাপ মুহূর্তেই কাটিয়ে ওঠেন গুরবাজ ও রহমত শাহ। দুজন মিলে তৃতীয় উইকেটে ৮৫ রানের জুটি গড়ে দলকে একদম নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যান।
রহমানুল্লাহ গুরবাজ ৭৬ বলে ৫০ রানের দায়িত্বশীল ইনিংস খেলে মেহেদী হাসান মিরাজের বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন। তার ইনিংসে ছিল ৪টি চার ও ১টি ছক্কা। রহমত শাহও একইভাবে ধীরস্থির থেকে ৭০ বলে ৫০ রান করে দলকে প্রায় জয় এনে দেন। আফগানদের রানরেট কখনো ৫-এর নিচে নামেনি, যা বাংলাদেশের বোলারদের হতাশা আরও বাড়িয়েছে।
শেষ দিকে আজমাতউল্লাহ ওমরজাই ও অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহিদি সহজ ব্যাটিংয়ে কাজ শেষ করেন। ওমরজাই ৪৪ বলে ৪০ রানের চমৎকার ইনিংস খেলে দলের জয় নিশ্চিত করেন। অন্য প্রান্তে শহিদি অপরাজিত থাকেন ৩৩ রানে। এরপর যখন মাত্র ২ রান দরকার, তখন অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবি এসে প্রথম বলেই ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ শেষ করেন—যা ছিল আফগানদের আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিফলন।
বাংলাদেশের পক্ষে বোলারদের মধ্যে তানজিম হাসান সাকিব ছিলেন সবচেয়ে সফল। তিনি ৩টি উইকেট নিয়েছেন, যদিও সাপোর্ট পাননি অন্য বোলারদের কাছ থেকে। শরীফুল, মিরাজ ও তাসকিন কেউই নিয়মিতভাবে উইকেট নিতে পারেননি। মিরাজ ব্যাট হাতে ভালো করলেও বল হাতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেননি।
এ ম্যাচে সবচেয়ে বড় পার্থক্য তৈরি করেছে পরিকল্পনা ও এক্সিকিউশন। আফগানিস্তান জানতো কিভাবে এই উইকেটে ব্যাট করতে হয়, কিভাবে বোলিংয়ের সময় ধৈর্য ধরতে হয়। বিপরীতে বাংলাদেশ বারবার ভুল করেছে—অযথা শট নির্বাচন, ধীর ব্যাটিং, আর বোলিংয়ে ধারাবাহিকতার অভাব।
এই জয়ে তিন ম্যাচ সিরিজে ১-০ তে এগিয়ে গেল আফগানিস্তান। পরের ম্যাচে বাংলাদেশের সামনে এখন সিরিজে টিকে থাকার লড়াই। টাইগারদের জন্য এটি কেবল একটি হার নয়, বরং তাদের ব্যাটিং অর্ডার ও কৌশল পুনর্বিবেচনার সময় এসে গেছে।
বাংলাদেশ দলের ম্যানেজমেন্টও স্বীকার করছে, ব্যাটিং ও বোলিং উভয় বিভাগেই উন্নতির জায়গা রয়েছে। বিশেষ করে টপ অর্ডারের ধারাবাহিকতা না থাকা ও স্পিনারদের বিপরীতে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি এখন বড় উদ্বেগের বিষয়।
অন্যদিকে, আফগান শিবিরে এখন উচ্ছ্বাস। রশিদ খান, গুরবাজ, রহমত শাহ, নবি—সবাই আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে তারা চাইবে জয় নিশ্চিত করে বাংলাদেশের বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় ছিনিয়ে নিতে।
আবুধাবিতে এই ম্যাচটি প্রমাণ করেছে—আধুনিক ক্রিকেটে পরিকল্পনা, ধৈর্য আর মানসিক দৃঢ়তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তান সেটাই দেখিয়েছে, আর বাংলাদেশ দেখিয়েছে সেই জায়গায় কতটা পিছিয়ে তারা। এখন সিরিজে ফিরে আসার দায়িত্ব তামিম-মুশফিক-মিরাজদের কাঁধে। না হলে আফগানিস্তানের কাছে আরেকটি লজ্জার সিরিজ পরাজয়ের মুখে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ