
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচিত হতে যাচ্ছে আগামীকাল রবিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৫ থেকে। সেদিন থেকে সারাদেশে প্রথমবারের মতো টাইফয়েড প্রতিরোধী টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত এই জাতীয় টিকা কর্মসূচিতে প্রায় ৫ কোটি শিশু ও কিশোর-কিশোরীকে বিনামূল্যে এই টিকা দেওয়া হবে—যাদের বয়স ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম।
এই টিকাদান কার্যক্রম চলবে পুরো এক মাসব্যাপী, ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত।
টাইফয়েড টিকাদানের এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় ক্যাম্পেইন। দীর্ঘদিন গবেষণা, প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পর অবশেষে এই টিকাটি দেশের শিশুদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। টিকাটি তৈরি করেছে ভারতের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, যারা এর আগে কোভিড-১৯ টিকার সফল সরবরাহকারী হিসেবেও পরিচিত ছিল।
সরকার এই টিকা পেয়েছে **টিকাবিষয়ক আন্তর্জাতিক জোট ‘গ্যাভি’**র সহযোগিতায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) টিকাটিকে অনুমোদন দিয়েছে এবং এটি ইতোমধ্যে নেপাল, পাকিস্তান, মালাউই, জিম্বাবুয়ে, ঘানা, কেনিয়া, ফিলিপাইন ও লাইবেরিয়াসহ একাধিক দেশে সফলভাবে দেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে) অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “টাইফয়েড টিকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত এবং বিভিন্ন দেশে প্রয়োগের পর কোনো বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার নজির পাওয়া যায়নি।”
তিনি আরও বলেন, “টাইফয়েড এখনও আমাদের দেশে একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে দূষিত খাবার ও পানির কারণে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিশু আক্রান্ত হয়। এই টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে আগামী কয়েক বছরে টাইফয়েড সংক্রমণ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে,
-
প্রাক্-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি বা সমমান পর্যায়ের সব ছাত্রছাত্রীকে এক ডোজ টাইফয়েড টিকা দেওয়া হবে।
-
যেসব শিশু স্কুলে যায় না, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়া হবে।
-
শহরাঞ্চলের পথশিশুরা যাতে বাদ না পড়ে, সে জন্য বিভিন্ন এনজিও সংস্থা মাঠ পর্যায়ে কাজ করবে।
-
জন্মসনদ বা জন্ম নিবন্ধন না থাকলেও শিশুরা টিকা পাবে, স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে নিবন্ধন সম্পন্ন করা হবে।
ইপিআই (Expanded Programme on Immunization) প্রোগ্রামের ম্যানেজার ডা. আবুল ফজল মো. শাহাবুদ্দিন খান জানান, “১২ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই টিকাদান ক্যাম্পেইনের প্রথম ১০ দিন স্কুল ও মাদ্রাসায় ক্যাম্প করে টিকা দেওয়া হবে, আর পরবর্তী ৮ দিন দেশের বিভিন্ন ইপিআই সেন্টারে দেওয়া হবে।”
অর্থাৎ, ১২ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এবং ৩১ অক্টোবর থেকে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইপিআই কেন্দ্রে এই টিকা দেওয়া হবে।
টিকাদান কার্যক্রমে অংশ নেবে ১ লাখেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক, যারা সারাদেশে ৬৪ জেলার স্কুল, মাদ্রাসা ও গ্রামীণ টিকাকেন্দ্রে কাজ করবেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ১ কোটি ৬৮ লাখ শিশু টিকা গ্রহণের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করেছে। তবে লক্ষ্যমাত্রা ৪ কোটি ৯০ লাখ শিশু।
টিকা গ্রহণের জন্য অভিভাবকদেরকে যেতে হবে https://vaxepi.gov.bd/registration/tcv ওয়েবসাইটে, সেখানে শিশুর ১৭-সংখ্যার জন্ম নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধনের পর জন্ম নিবন্ধন সনদের মাধ্যমে সরাসরি ভ্যাকসিন কার্ড ডাউনলোড করা যাবে।
যাদের জন্ম নিবন্ধন নেই, তারা নিকটস্থ টিকাকেন্দ্র বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্যে হাতে লিখে নিবন্ধন করতে পারবেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে বড় অংশই শিশু-কিশোর। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ শহরাঞ্চলে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবের কারণে টাইফয়েড এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
আইইডিসিআর-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শিশুদের মধ্যে টাইফয়েডজনিত জ্বর এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার হার বেড়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই টিকা নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশের শিশুস্বাস্থ্য সূচকে একটি নতুন মাইলফলক স্থাপন হবে।
টাইফয়েড টিকাটির নাম Typhoid Conjugate Vaccine (TCV)। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা প্রদানকারী টিকা, যার কার্যকারিতা কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, এক ডোজ টিকা গ্রহণের পর ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে ওঠে।
নেপাল ও পাকিস্তানে এই টিকা দেওয়ার পর টাইফয়েড সংক্রমণ ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান জানিয়েছেন, “এই ক্যাম্পেইন সফল হলে টাইফয়েড টিকাকে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যেমন হাম, রুবেলা ও হেপাটাইটিস বি টিকা।”
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য শুধু টাইফয়েড প্রতিরোধ নয়, বরং দেশের শিশুস্বাস্থ্যকে আরও শক্তিশালী করা। গ্যাভির সহায়তায় আমরা ভবিষ্যতে এই টিকা স্থায়ীভাবে প্রবর্তনের পরিকল্পনাও করছি।”
বাংলাদেশে টাইফয়েড টিকার এই প্রথম জাতীয় কর্মসূচি শুধু একটি টিকাদান নয়, বরং একটি জনস্বাস্থ্য বিপ্লবের সূচনা। সরকারের আশা—এই উদ্যোগ দেশের শিশুদের জন্য এক স্থায়ী সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে টাইফয়েডজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ