
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সামাজিক ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীদের বিরুদ্ধে অপতথ্য, গুজব ও ডিজিটাল সহিংসতা ক্রমশ উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। চলতি বছরের নয় মাসে রিউমর স্ক্যানারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ২৭৬ জন নারীর ছবি, ভিডিও ও তথ্যকে কেন্দ্র করে ৫ শতাধিক ভুয়া বা বিভ্রান্তিমূলক কনটেন্ট ছড়ানো হয়েছে। এই সময়ে অপতথ্য ও গুজবের প্রায় ২১ শতাংশই নারীদের উপর লক্ষ্যবস্তু হয়েছে।
বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, শোবিজের নারীরা এই সহিংসতার প্রধান শিকার। ভুয়া ভিডিও, এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি কনটেন্ট, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কনটেন্ট এবং মৃত্যুর গুজব সহ বিভিন্ন অপপ্রচার সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। এসব ডিজিটাল সহিংসতার কারণে নারী শিল্পীরা প্রতিনিয়ত হেনস্তা, বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
রিউমর স্ক্যানারের তথ্যমতে, চলতি বছরের নয় মাসে ২৯ জন নারী অভিনেত্রীকে কেন্দ্র করে ৬৮টি গুজব ও অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি কনটেন্টে এআই বা ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ভুয়া কনটেন্টের ৩৬টি ঘটনায় ভারতীয় নারীর ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের শোবিজ তারকার ছবি বা ভিডিও দাবি করে ছড়ানো হয়েছে।
এই ২৯ অভিনেত্রীর মধ্যে রয়েছেন:
-
নুসরাত ইমরোজ তিশা
-
সাদিয়া আয়মান
-
আজমেরী হক বাঁধন
-
প্রার্থনা ফারদিন দীঘি
-
তানজিম সাইয়ারা তটিনী
-
বিদ্যা সিনহা সাহা মিম
-
তাসনিয়া ফারিণ
-
মাহিয়া মাহি
-
শবনম বুবলী
-
অপু বিশ্বাস
-
নাজনীন নাহার নিহা
-
রাফিয়াথ রশিদ মিথিলা
-
মেহজাবীন চৌধুরী
-
শবনম ফারিয়া
গত নয় মাসে সবচেয়ে বেশি অপতথ্যের শিকার হয়েছেন সাদিয়া আয়মান, যাকে নিয়ে ১১টি ভুয়া কনটেন্ট ছড়ানো হয়েছে, যার ১০টি এআই ভিত্তিক। অভিনেত্রী এই বিষয়ে বলেন, “যারা এটা করছে তারা ভয়াবহ অপরাধ করছে। এককভাবে সমাধান না করে, যারা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তারা একজোট হয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।”
সাদিয়া জানিয়েছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়ার কারণে কিছু ভুয়া ও অপপ্রচার তাঁর দিকে লক্ষ্য করা হতে পারে। তিনি বলেন, “আমি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অংশ নিইনি, শুধু ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেছি। কিন্তু এ কারণে এ ধরনের ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হচ্ছি।”
নাজনীন নাহার নিহা, শবনম ফারিয়া এবং মেহজাবীন চৌধুরীও চলতি বছরে একাধিকবার ভুয়া ছবি, ভিডিও এবং ডিপফেকের শিকার হয়েছেন। মেহজাবীন বলেন, “প্রযুক্তি আমাদের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। তবে এর অন্ধকার দিকও আছে। এআই বা অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ভুল হাতে গেলে মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে, বিভ্রান্তি তৈরি করে এবং সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এটি শুধু অনৈতিক নয়, ফৌজদারি অপরাধও বটে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের ডিজিটাল সহিংসতা প্রতিরোধ করতে দরকার কঠোর আইন, সচেতনতা এবং শক্তিশালী ব্যবস্থা। নারীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সম্মানজনক অনলাইন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।”
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ‘চলো বদলে যাই’ নামে একটি ফেসবুক পেইজ ও অন্যান্য কয়েকটি পেইজ নিয়মিত ভুয়া ছবি ও ভিডিও ছড়াচ্ছে। পুলিশ জানিয়েছে, কারও অনুমতি ছাড়া আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা ২০২৩ সালের সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ। ভুক্তভোগীরা সিআইডি, ডিএমপি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন এবং পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেনে অভিযোগ করতে পারেন।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার সুবিধাজনক হলেও এর অপব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে শোবিজের নারী শিল্পীরা এই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দ্রুত উদ্যোগ না নিলে পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে ভুয়া কনটেন্ট, অপতথ্য এবং ডিজিটাল সহিংসতার প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
সারসংক্ষেপে, চলতি বছরের নয় মাসে ডিজিটাল সহিংসতার শিকার হওয়া ২৯ নারী অভিনেত্রী এই সমস্যার তীব্রতা তুলে ধরেছেন। ভুয়া ভিডিও, ডিপফেক, এআই ভিত্তিক কনটেন্ট এবং অপতথ্য ছড়ানো শুধু ব্যক্তিগত সম্মানহানি নয়, বরং সামাজিক ও আইনি প্রেক্ষাপটেও উদ্বেগের কারণ। শিল্পী, নাগরিক সমাজ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা একযোগে উদ্যোগ নিলে নারীদের জন্য অনলাইন নিরাপত্তা ও সম্মানজনক পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।