
ছবি: সংগৃহীত
শরীর দুর্বল, সর্দি-কাশি বারবার, ছোটোখাটো অসুস্থতা সহজেই ধরছে? অনেকেই ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে এটি যুক্ত করে ফেলেন। কিন্তু সমস্যা যদি নিয়মিতভাবে দেখা দেয়, তবে এটি শুধুমাত্র ঋতুর দোষ নয়; বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কিছু অভ্যাসই হতে পারে এর পেছনের মূল কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভ্যাসগুলো অজান্তেই আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে, ফলে সংক্রমণ, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
আধুনিক জীবনযাত্রার অন্যতম বড় সমস্যা হলো ঘুমের অভাব। দীর্ঘ কাজের চাপ, মানসিক উদ্বেগ, বা গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল ঘাঁটার অভ্যাসে ঘুমের সময় কমে আসে। প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ৭-৮ ঘণ্টা গভীর ঘুম প্রয়োজন। চিকিৎসকদের মতে, ঘুমের সময় শরীর “সাইটোকাইন” নামে একটি প্রোটিন উৎপন্ন করে, যা সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। ঘুম কম হলে এই প্রোটিনের উৎপাদনও কমে যায়, ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়। বিশেষ করে যারা রাতে কাজের চাপ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন, তাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে ভিটামিন, খনিজ ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার অপরিহার্য। কিন্তু ব্যস্ত জীবনের কারণে আমাদের খাদ্যতালিকায় সবুজ শাক-সবজি, ফলমূলের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে ফাস্ট ফুড, প্রসেসড খাবার এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত পানীয়। এই ধরনের খাবার শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিটামিন সি, ডি এবং জিঙ্কের অভাব শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সাময়িক মানসিক চাপ ক্ষতিকর নয়, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ বা ক্রনিক স্ট্রেস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য মারাত্মক। দীর্ঘ সময় মানসিক চাপ থাকলে শরীর ‘কর্টিসল’ নামক স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে। হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলে তা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার স্বাভাবিক কাজকর্মকে দমিয়ে দেয়। ফলে সংক্রমণের মোকাবেলার ক্ষমতা কমে যায়। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে সাধারণ ঠান্ডা বা ভাইরাসের সংক্রমণও দীর্ঘ সময় ধরে দেহকে কষ্ট দেয়।
নিষ্কর্মা জীবনযাপনও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমানোর একটি বড় কারণ। নিয়মিত ব্যায়াম করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং ‘ইমিউন সেল’ বা রোগ প্রতিরোধকারী কোষ সারা শরীরে দক্ষতার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ব্যায়ামের অভাবে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যার ফলে জীবাণু এবং ভাইরাসের আক্রমণের জন্য শরীর আরও সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা হালকা থেকে মাঝারি ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করতে সাহায্য করে।
ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপানের ক্ষতিকর প্রভাব সকলেই জানেন। তামাকে থাকা রাসায়নিক এবং অ্যালকোহল সরাসরি শ্বেত রক্তকণিকার কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। এই কারণে যাঁরা নিয়মিত ধূমপান বা মদ্যপান করেন, তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বারবার অসুস্থ হওয়াকে কেবল আবহাওয়ার দোষ দিয়ে এড়িয়ে গেলে চলবে না। নিজের জীবনযাত্রা পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম এবং মানসিক চাপমুক্ত জীবনই শরীরের প্রাকৃতিক বর্মকে মজবুত রাখতে পারে। এছাড়া পর্যাপ্ত পানি পান, প্রাকৃতিক ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ, ধূমপান ও অ্যালকোহল এড়ানো এবং নিয়মিত মেডিটেশন বা শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জোরদার করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষা। দৈনন্দিন অভ্যাসগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তবে আমরা অজান্তেই নিজেদের সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছি। তাই স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, সুষম খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত শারীরিক কার্যক্রমই প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ