
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য আমদানির নির্দেশ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, এ বছর ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) মজুত থাকায় আমদানিতে কোনো ধরনের সংকট বা জটিলতা দেখা দেবে না। ফলে রমজানের আগে থেকেই বাজারে পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক, যাতে ক্রেতারা অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির চাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন।
প্রতি বছর রমজান মাসে দেশের বাজারে ছোলা, খেজুর, ডাল, পেঁয়াজ, চিনি, ভোজ্যতেল, মসলা, আটা ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এ সময়ে সরবরাহ ঘাটতি ও কৃত্রিম সংকটের কারণে অনেক সময় বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। এ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এবার বাংলাদেশ ব্যাংক অগ্রিম উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে “চাহিদার চেয়ে বেশি সরবরাহ” নিশ্চিত করা যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, রমজানের জন্য নির্ধারিত আমদানি লক্ষ্যমাত্রার বাইরে গিয়ে প্রয়োজনবোধে অতিরিক্ত পণ্য আমদানি করা যাবে। প্রয়োজনে এসব পণ্য রমজানের পরও বাজারে বিক্রি করা হবে, যাতে বাজারে কোনো সময়েই ঘাটতি না দেখা দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বিদেশ সফরে যাওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন, রমজান-পূর্ব সময়টিতে কোনো আমদানিকারক যেন ব্যাংক থেকে এলসি (Letter of Credit) খোলার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন না হন। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার ক্রয়ের প্রক্রিয়া সাময়িকভাবে স্থগিত রাখারও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
তবে গভর্নর আরও বলেছেন, “যদি ডলার পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাভাবিক ডলার ক্রয় প্রক্রিয়া চালিয়ে যাবে।”
২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্রয় করেছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি রিজার্ভ শক্তিশালী করা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে ডলার সংকট আমদানি বাণিজ্যে বড় প্রভাব ফেলেছিল। পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত ডলার জোগাড় করতে পারছিল না। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টেছে। এক ঊর্ধ্বতন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আগে ডলার সংকটের কারণে অনেক সময় পণ্য আমদানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ করে ডলার সরবরাহ করতে হতো। এখন বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিজস্বভাবে পর্যাপ্ত ডলার মজুত আছে। ফলে তারা স্বাধীনভাবে আমদানির এলসি খুলতে পারছে, যা বাজারে স্থিতিশীলতা আনছে।”
এই কর্মকর্তা আরও জানান, ব্যাংকগুলো এখন ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থায়’ রয়েছে; তাই বাংলাদেশ ব্যাংক এবার আগাম নির্দেশনা দিয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানির জন্য, যাতে রমজানের সময় কোনোভাবেই সরবরাহ সংকট দেখা না দেয়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে দেশের শীর্ষ ২০ আমদানিকারকের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে রমজান মাসে বাজারে পণ্যের চাহিদা, আমদানি প্রক্রিয়া, শুল্ক সুবিধা এবং ডলার লেনদেনের পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন দেশের প্রধান প্রধান খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান— মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল, নাবিল গ্রুপ, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, ডেলটা অ্যাগ্রো ফুড প্রভৃতি কোম্পানির প্রতিনিধি।
বৈঠকে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আমদানিকারকদের আশ্বস্ত করেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পাশে থাকবে এবং শুল্কসংক্রান্ত কোনো সমস্যা হলে দ্রুত সমাধান করা হবে। তিনি আরও বলেন,“রমজানকে ঘিরে কোনোভাবেই খাদ্যপণ্যের ঘাটতি বা বাজার অস্থিরতা তৈরি হতে দেওয়া হবে না। প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই হস্তক্ষেপ করবে।”
প্রখ্যাত কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, সরকার ইতিমধ্যে রমজানে ব্যবহৃত প্রধান ভোগ্যপণ্য— যেমন ছোলা, ডাল, পেঁয়াজ, তেল, চিনি ও খেজুর— এসবের ওপর শুল্ক ছাড় ও ট্যারিফ কমানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ফলে আমদানিকারকেরা এখন সহজে পণ্য আনতে পারছেন এবং তারা আগ্রহীও হয়েছেন বেশি পরিমাণ আমদানি করতে।
তিনি বলেন, “সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে এবারের রমজানে বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আগাম আমদানি ও শুল্ক ছাড়ের কারণে দামও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকবে। এতে ভোক্তারা উপকৃত হবেন, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ।”
অর্থনীতিবিদ ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ বাজারে একাধিক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
১. পণ্যের সরবরাহ বাড়বে, ফলে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
২. মজুতদারি ও কৃত্রিম সংকটের সুযোগ কমবে।
৩. বাজারে আস্থা ফিরে আসবে, কারণ আগাম আমদানির ঘোষণা ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করবে।
৪. রিজার্ভে চাপ পড়বে না, কারণ ব্যাংকগুলো এখন নিজেদের মজুত ডলার থেকেই এলসি খুলতে পারছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, এ মুহূর্তে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক লেনদেন সক্ষমতা নিরাপদ সীমায় আছে। নতুন মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট করেছে, পণ্য আমদানি ও রপ্তানি—উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলোকে ‘মার্কেট-ভিত্তিক লেনদেন’ বজায় রাখতে হবে, যাতে অপ্রয়োজনীয় সরকারি হস্তক্ষেপ কমে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই নীতি দেশের “বাণিজ্যিক আস্থা” পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত রমজান মাসে ভোগ্যপণ্য সরবরাহ ও মূল্য স্থিতিশীল রাখার একটি অগ্রণী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এবার আর ডলার সংকট, এলসি জটিলতা বা পণ্য ঘাটতির মতো সমস্যায় ভোগার আশঙ্কা নেই।
গভর্নরের নির্দেশনা অনুযায়ী, “সরবরাহ থাকবে পর্যাপ্ত, দাম থাকবে সহনীয়”— এমন একটি স্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি নিশ্চিত করাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসরকারি আমদানিকারকদের সমন্বিত এই উদ্যোগের ফলে ভোক্তারা এ রমজানে স্বস্তির বাজার পরিস্থিতি আশা করতে পারছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ