
ছবি: সংগৃহীত
গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত মারাত্মক চাপে পড়েছে। গত এক বছরে ১৮২টি তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প খাতে এক ভয়াবহ সংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে, রপ্তানি অর্ডার কমেছে, ব্যাংক ঋণ পরিশোধে জটিলতা তৈরি হয়েছে, আর কর্মসংস্থানে নেমেছে বড় ধাক্কা।
রোববার (১২ অক্টোবর) রাজধানীতে সংগঠনটির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশন (বিজিবিএ) এ তথ্য প্রকাশ করে। সংগঠনের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল বলেন, “দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অস্থিরতা এবং কাঁচামালের দামবৃদ্ধির কারণে অনেক উদ্যোক্তা উৎপাদন টিকিয়ে রাখতে পারছেন না। ফলে তারা একে একে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরের শেষ দুই মাসে রপ্তানি আয় প্রায় ৫-৬ শতাংশ কমে গেছে। পোশাক শিল্প বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশ জুড়ে রাখে, ফলে এই পতন অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বিজিবিএর নেতারা বলেন, “একটি কারখানা বন্ধ হওয়া মানে কেবল উৎপাদন বন্ধ নয়; এর সঙ্গে জড়িত অসংখ্য শ্রমিকের জীবিকা, ডজনখানেক বায়িং হাউস, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের আস্থা ও দেশের শিল্প খাতের ভাবমূর্তি।”
তাদের মতে, এখন প্রতিটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার পেছনে গল্প আছে— কেউ টিকতে পারেননি গ্যাসচাপের ওঠানামায়, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এলসি (Letter of Credit) জটিলতায়, আবার কেউ বিদেশি ক্রেতাদের ‘পেমেন্ট ডিলে’ ভুগেছেন।
বিজিবিএর পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত একাধিক সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে— যেমন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিজিএটিএমইএ ও বিজিবিএ— কিন্তু তাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের কোনো একক কাঠামো নেই।
সংগঠনের সভাপতি বলেন, “আমরা সবাই একই শিল্পের অংশ, কিন্তু সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম না থাকায় সংকটের সময়ে যৌথ কৌশল নির্ধারণ সম্ভব হয় না। ফলে প্রতিটি সংগঠন নিজ নিজভাবে লড়াই করছে, যা কোনোভাবেই টেকসই নয়।”
বিজিবিএ মনে করে, এই সমন্বয়ের অভাবই শিল্পখাতে নীতি-সহযোগিতার ঘাটতি তৈরি করেছে, ফলে অনেক উদ্যোক্তা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
কারখানা বন্ধ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নেতারা জানান, একদিকে উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নেই, অন্যদিকে বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহে দিনে কয়েক ঘণ্টা করে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
এর ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্ডার সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না, ক্রেতাদের কাছ থেকে জরিমানা দিতে হচ্ছে, আবার অনেক বিদেশি ক্রেতা নতুন অর্ডার বাতিল করছেন।
সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ পিন্টু বলেন, “আমাদের অনেক কারখানার উৎপাদনক্ষমতা অর্ধেকে নেমে গেছে। একদিকে বিদ্যুৎ নেই, অন্যদিকে ডলার সংকট। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হচ্ছেন উৎপাদন বন্ধ করতে।”
বিজিবিএর হিসাব অনুযায়ী, ১৮২টি কারখানা বন্ধ মানে কমপক্ষে দেড় লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হারানো। শুধু শ্রমিক নয়, এর সঙ্গে যুক্ত পরিবহন খাত, প্যাকেজিং, বীমা, ব্যাংক, রপ্তানি-লজিস্টিকসসহ আরও বহু উপখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিটি কারখানা বন্ধের সঙ্গে একাধিক বায়িং হাউস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ তাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। ক্রেতারা এখন অন্য দেশের দিকে ঝুঁকছেন, যেমন ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া— যাদের বিদ্যুৎ ও লজিস্টিক অবকাঠামো তুলনামূলক স্থিতিশীল।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবিএ সাতটি সুপারিশ দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন হলে খাতটি পুনরুজ্জীবিত হতে পারে বলে তাদের আশা। সেগুলো হলো—
১. কারখানা নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স কঠোরভাবে নিশ্চিত করা।
২. রপ্তানির সময়সীমা নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সহায়তা দেওয়া।
৩. এলসি প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্নে ব্যাংক ও কারখানাকে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ও ম্যান-মেড ফাইবার ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া।
৫. নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৬. অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়াতে আন্তর্জাতিক মেলা আয়োজন।
৭. এলডিসি উত্তরণ প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা, যাতে রপ্তানি প্রণোদনা হারিয়ে না যায়।
সভায় বক্তারা বলেন, “এই সাতটি সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলে শিল্পখাতের ধস ঠেকানো কঠিন হবে।
নেতারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে উচ্চ শুল্ক এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশি ক্রেতারা নতুন অর্ডার দিতে দ্বিধায় রয়েছেন। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার খুচরা বাজারে মন্দাভাবও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমাচ্ছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট সাইফুর রহমান ফরহাদ বলেন, “আমাদের অনেক ক্রেতা এখন ভিয়েতনাম, চীন ও ভারত থেকে পোশাক নিচ্ছেন। তারা বলছেন— বাংলাদেশে উৎপাদন সময়মতো শেষ করা যাচ্ছে না। এটি খুবই উদ্বেগজনক।”
তিনি আরও বলেন, “যদি উৎপাদন অবকাঠামো ঠিক না হয়, তবে আগামী বছর রপ্তানি ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।”
কারখানা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক ঋণ খেলাপি বাড়ছে। অনেক উদ্যোক্তা ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। ব্যাংকগুলো এখন নতুন করে পোশাক খাতে ঋণ দিতে অনীহা প্রকাশ করছে, যা বিনিয়োগ স্থবির করে দিয়েছে।
বিজিবিএর মহাসচিব জাকির হোসেন বলেন, “আমাদের অনেক সদস্য ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। আবার ব্যাংকগুলোও ডলার সংকটের অজুহাতে এলসি খোলায় বিলম্ব করছে। এর ফলে পুরো ভ্যালু চেইন ভেঙে পড়ছে।”
সংগঠনের সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন পাভেল বলেন, “আমরা চাই সরকার, বায়িং হাউস, ক্রেতা ও রপ্তানিকারকদের এক ছাতার নিচে এনে একটি কার্যকর সমন্বিত টাস্কফোর্স গঠন করুক। এই শিল্পকে বাঁচাতে এখনই সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। সময় পেরিয়ে গেলে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “পোশাক শিল্প শুধু রপ্তানি নয়, এটি দেশের কর্মসংস্থানের হৃদস্পন্দন। এই খাত ভেঙে পড়লে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে।”
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। কিন্তু গত এক বছরে ১৮২টি কারখানা বন্ধ হওয়া এ শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, ডলার জট, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বৈদেশিক বাজারে অনিশ্চয়তা—সব মিলিয়ে খাতটি এখন টিকে থাকার লড়াই করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন প্রয়োজন সরকার, উদ্যোক্তা ও ক্রেতা—এই তিন পক্ষের যৌথ উদ্যোগ, যাতে এই শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ