
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বাজারে আবারও সোনার দাম রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি মাসের অর্ধেক সময়ও না যেতেই টানা ষষ্ঠবারের মতো বাড়ানো হলো এই মূল্যবান ধাতুর দাম। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন দাম সমন্বয়ের ঘোষণা দেয়। ঘোষণায় জানানো হয়, বুধবার (১৫ অক্টোবর) থেকে দেশের বাজারে ভালো মানের বা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে—যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এতে এক দিনে প্রতি ভরি সোনার দাম ২ হাজার ৬১৩ টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ এক দিনের ব্যবধানে এটিই চলতি বছরের সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধি। তবে রুপার বাজারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি; সেখানে দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমানে প্রতি ভরি রুপা বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ২০৫ টাকায়, যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায়ও তুলনামূলকভাবে উচ্চমানের বলে জানিয়েছে বাজুস।
বাজুস জানায়, বৈশ্বিক বাজারে খাঁটি বা তেজাবি সোনার দামের ধারাবাহিক উত্থানের প্রভাব স্থানীয় বাজারেও পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সোনার দাম প্রতি আউন্সে ২ হাজার ৭০০ ডলার অতিক্রম করেছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলেই বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাজারগুলোতে সোনার দাম ক্রমাগত বাড়ছে।
বাজুসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশীয় বাজারেও দাম সমন্বয় করা হয়েছে। এটি বাধ্যতামূলক ছিল, কারণ আমদানি পর্যায়ে খাঁটি সোনার দাম বাড়ায় রিফাইনারি ও খুচরা বিক্রেতাদের খরচ বেড়েছে।”
চলতি অক্টোবর মাসে এটি সোনার দামের ষষ্ঠ সমন্বয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ছয়টি সমন্বয়ের একটিতেও দাম কমেনি, বরং প্রতিবারই বেড়েছে। সর্বশেষ ৭ অক্টোবর সোনার দাম প্রথমবারের মতো দুই লাখ টাকার মাইলফলক অতিক্রম করেছিল।
তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের আগস্টে যেখানে ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার ঘরে, মাত্র ২৬ মাসের ব্যবধানে সেটি দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলার ঘাটতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, এবং বিনিয়োগকারীদের ‘সেফ হ্যাভেন’ হিসেবে সোনার চাহিদা বেড়ে যাওয়াই এর প্রধান কারণ।
বাজুসের ঘোষণায় বলা হয়েছে, বুধবার থেকে দেশের বাজারে সোনার নতুন দাম কার্যকর হবে।
২২ ক্যারেট সোনা (হলমার্কযুক্ত): ভরিপ্রতি ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা
২১ ক্যারেট সোনা: ভরিপ্রতি ২ লাখ ৬ হাজার ৪৯৯ টাকা
১৮ ক্যারেট সোনা: ভরিপ্রতি ১ লাখ ৭৭ হাজার ১ টাকা
সনাতন পদ্ধতির সোনা: ভরিপ্রতি ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৫১ টাকা
আগের তুলনায় ভরিপ্রতি বৃদ্ধির হার হিসেবে দেখা যাচ্ছে—২২ ক্যারেটে ২ হাজার ৬১৩ টাকা, ২১ ক্যারেটে ২ হাজার ৪৯৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটে ২ হাজার ১৪৬ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনায় ১ হাজার ৮৩১ টাকা বেড়েছে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত বাজারে ২২ ক্যারেটের সোনা বিক্রি হচ্ছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৭১৯ টাকায়, ২১ ক্যারেট ২ লাখ ৪ হাজার ৩ টাকায়, ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫৫ টাকায় এবং সনাতন পদ্ধতির সোনা ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫২০ টাকায়।
বাজুস জানায়, রুপার বাজারে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। বর্তমানে ২২ ক্যারেটের রুপার ভরিপ্রতি দাম ৬ হাজার ২০৫ টাকা অপরিবর্তিত থাকছে। একইভাবে ২১ ক্যারেটের রুপা বিক্রি হবে ৫ হাজার ৯১৪ টাকায়, ১৮ ক্যারেটের ৫ হাজার ৭৪ টাকায় এবং সনাতন পদ্ধতির রুপা ৩ হাজার ৮০২ টাকায়।
রুপার দাম অপরিবর্তিত রাখার কারণ হিসেবে সমিতি জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে রুপার দামে বড় ধরনের ওঠানামা হয়নি, ফলে স্থানীয় বাজারে সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়নি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সোনার ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি দেশের সাধারণ জনগণের জন্য একটি ‘সতর্ক সংকেত’। ডলারের ঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপের মধ্যে সাধারণ মানুষ এখন নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার দিকে ঝুঁকছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামীম আহমেদ বলেন, “বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সোনা একটি বিকল্প সম্পদ হিসেবে কাজ করছে। বিনিয়োগকারীরা নগদ অর্থ ধরে রাখার পরিবর্তে সোনায় বিনিয়োগ করছেন, কারণ তারা এটিকে স্থিতিশীল সম্পদ মনে করছেন। তবে এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি বিশ্ববাজারে সোনার দাম একই ধারা বজায় রাখে, তাহলে আগামী কয়েক মাসে বাংলাদেশের বাজারে ভরিপ্রতি দাম ২ লাখ ২৫ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে।”
সোনার দাম বাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজধানীর বানিজ্যিক এলাকা বায়তুল মোকাররম ও নিউমার্কেটের গয়নার দোকানগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় কমে গেছে। অনেকেই পুরনো সোনা বিক্রির দিকে ঝুঁকছেন। দোকান মালিকরা বলছেন, বিক্রি কমলেও পুরনো সোনা জমা দেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে।
গোল্ড ট্রেডার শওকত হোসেন বলেন, “মানুষ এখন নতুন সোনা কিনতে ভয় পাচ্ছে। দাম যে গতিতে বাড়ছে, তাতে সাধারণ ক্রেতা বাজার থেকে প্রায় সরে গেছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, সোনার এই মূল্যবৃদ্ধি সাময়িকভাবে স্থিতিশীল না হলে বাজারে তার প্রভাব পড়বে বিয়ের মৌসুমে। ঐতিহ্যগতভাবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে বিয়ের মৌসুমে সোনার চাহিদা বেড়ে যায়। দাম এত উঁচু অবস্থায় থাকলে অনেকেই বিকল্প ধাতু বা হালকা গয়নার দিকে ঝুঁকতে পারেন।
বাজুসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তারা দ্রুত পুনর্মূল্যায়ন করবে। তবে আপাতত বাজারের ওপর নজর রাখা হচ্ছে, যাতে কেউ অযৌক্তিকভাবে দাম আরও না বাড়ায়।
মোট কথা, এক মাসে ছয়বারের মতো সোনার দাম বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতি ও ক্রেতা বাজারের জন্য নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে। ২২ ক্যারেট সোনার দাম ২ লাখ ১৬ হাজার টাকায় পৌঁছে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যয়বহুল সোনার বাজারে পরিণত হলো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ