
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) খাতে আবারও ভয়াবহ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। জনপ্রিয় টিকেটিং ও ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল’ বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহণ করে কার্যত লাপাত্তা হয়ে গেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের অনলাইন ব্যবসায় (ই-কমার্স ও ওটিএ) খাতে আরেকটি বড় প্রতারণা কেলেঙ্কারি হিসেবে এই ঘটনাটি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) থেকে প্রতিষ্ঠানটির বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত প্রধান কার্যালয় বন্ধ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে বন্ধ রয়েছে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (flyfar.com) এবং কাস্টমার কেয়ার হটলাইনসহ সব ধরনের ফোন নম্বর। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিপণন বিভাগ ও অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নম্বরেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এতে শত শত গ্রাহক তাদের বুকিং করা বিমান টিকিট, হোটেল রিজার্ভেশন বা বিদেশ ভ্রমণ প্যাকেজের কোনো তথ্য না পেয়ে মারাত্মক অনিশ্চয়তা ও দিশেহারার মধ্যে পড়েছেন।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অভিযোগ, আসন্ন ছুটির মৌসুমকে সামনে রেখে ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেজগুলোতে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডসহ জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে অস্বাভাবিক ছাড়ের অফার ঘোষণা করে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামভিত্তিক প্রমোশনাল পোস্টগুলোতে “৭০ শতাংশ ছাড়ে ইউরোপ ট্যুর”, “মক্কা-মদিনা ট্যুর মাত্র ৪৯ হাজার টাকায়”, “ফ্যামিলি ট্রিপে ১ কিনলে ১ ফ্রি” ইত্যাদি আকর্ষণীয় বার্তা দেওয়া হয়।
এই অফারগুলো দেখে বহু গ্রাহক তড়িঘড়ি করে অগ্রিম টাকা পাঠান—কেউ বিকাশে, কেউ নগদে, কেউ ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে। অনেকেই কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করেছেন, কিন্তু নির্ধারিত সময় ঘনিয়ে আসার পরও তারা কোনো টিকিট, বুকিং ভাউচার বা পাসপোর্ট ফেরত পাননি।
একজন ভুক্তভোগী, ঢাকার গুলশানের বাসিন্দা তানিয়া রহমান জানান, তিনি ও তার দুই বান্ধবী ‘ফ্লাই ফার লেডিস’-এর মাধ্যমে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মালদ্বীপ সফরের জন্য ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেন। কিন্তু এরপর থেকে কোনো টিকিট বা ট্রাভেল কনফার্মেশন পাননি। এখন অফিস বন্ধ, ফোন বন্ধ, কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না।
আরেক গ্রাহক রাজীব আহমেদ বলেন, “আমার দুবাই ভ্রমণের জন্য ৮২ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। প্রথমে তারা বলেছিল টিকিট ইস্যু প্রক্রিয়াধীন, পরে অফিসে গেলে বলে সিস্টেমে সমস্যা। মঙ্গলবার দেখি পুরো অফিস বন্ধ। আমি সম্পূর্ণ প্রতারিত হয়েছি।”
ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘদিন ধরে ‘ফ্লাই ফার ট্রিপস’ ও নারী পর্যটকদের জন্য বিশেষভাবে প্রচারিত ব্র্যান্ড ‘ফ্লাই ফার লেডিস’ নামেও ব্যবসা পরিচালনা করছিল। প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের “বাংলাদেশের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন ট্রাভেল ব্র্যান্ড” হিসেবে প্রচার করত। বিশেষ করে নারী ভ্রমণকারীদের লক্ষ্য করে পরিচালিত ‘ফ্লাই ফার লেডিস’ ব্র্যান্ডটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
অল্প সময়েই অসংখ্য নারী তাদের নিরাপদ ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য এই ব্র্যান্ডকে অনুপ্রেরণা হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সেই আস্থা আজ ভয়ংকর প্রতারণায় রূপ নিয়েছে। অসংখ্য নারী ভুক্তভোগী জানাচ্ছেন, তারা আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে এখানে বুকিং করেছিলেন, কারণ ‘ফ্লাই ফার লেডিস’ ছিল নারী নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, দেশের ওটিএ খাতে এ ধরনের প্রতারণার ঝুঁকি দীর্ঘদিন ধরেই বাড়ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের অনুমোদন বা লাইসেন্স ছাড়াই কেবল ট্রেড লাইসেন্সের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছে।
তিনি বলেন, “আমরা বহুবার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিভিল এভিয়েশন), পর্যটন বোর্ড ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে জানিয়েছি যে, অনলাইন টিকেটিং ব্যবসার জন্য একটি শক্তিশালী নিবন্ধন প্রক্রিয়া জরুরি। কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে একের পর এক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা নিয়ে উধাও হচ্ছে।”
ফ্লাই ফারের প্রতারণার শিকার শত শত গ্রাহক এখন ট্যুরিস্ট পুলিশ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে অভিযোগ জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হ্যাশট্যাগ #FlyFarScam ব্যবহার করে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন। কিছু গ্রাহক দাবি করেছেন, প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “আমরা প্রাথমিকভাবে কিছু অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। প্রমাণ পাওয়া গেলে এটি বড় ধরনের অর্থ আত্মসাত মামলা হিসেবে বিবেচিত হবে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনা বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের পুরোনো কেলেঙ্কারি—‘ই-অরেঞ্জ’, ‘ধামাকা’, ‘আনন্দবাজার’ বা ‘পিকাবু’-এর মতো ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। তখনও ছাড় ও লোভনীয় অফারের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পরে উদ্যোক্তারা উধাও হয়ে যান।
অর্থনীতিবিদ ড. মেহেদী হাসান বলেন, “এটি প্রমাণ করছে যে, শুধু ই-কমার্স নয়, ওটিএ খাতেও এখন অগ্রিম টাকার ব্যবসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি না থাকলে গ্রাহকের টাকা রক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। সরকারকে এখনই অনলাইন ট্রাভেল খাতের জন্য পৃথক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গঠন করতে হবে।”
ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনাল হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ায় এখন প্রশ্ন উঠছে—‘শেয়ারট্রিপ’, ‘গো জায়ান’, ‘ট্রাভেলজু’ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ট্রাভেল প্ল্যাটফর্মগুলো কতটা নিরাপদ? যেহেতু প্রায় সব ওটিএ অগ্রিম টাকা ছাড়া টিকিট ইস্যু করে না, তাই একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা পুরো শিল্পের ওপর গ্রাহকের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশের অনলাইন টিকিট বিক্রি ও ভ্রমণ প্যাকেজ খাতে প্রতি মাসে শত কোটি টাকার লেনদেন হয়। এর বড় অংশই অগ্রিম ভিত্তিক। যদি সরকার দ্রুত এই খাতে একটি মাননির্ধারণ ও তদারকি ব্যবস্থা না আনে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান একই পথে হাঁটবে।
বর্তমানে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে—তারা আর কোনো ওটিএতে অগ্রিম টাকা দিতে চান না। কিন্তু অনলাইন বুকিং পদ্ধতিতে অগ্রিম পরিশোধ বাধ্যতামূলক হওয়ায় কার্যত তারা এক অনিশ্চিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
এই ঘটনা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, বরং বাংলাদেশের ডিজিটাল ব্যবসা ও গ্রাহক সুরক্ষার দুর্বলতার প্রতিফলন। একের পর এক প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অনলাইন অর্থনীতিতে গ্রাহকের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ফ্লাই ফার ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফলে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান, মালিকদের অবস্থান, কিংবা গ্রাহকের অর্থ ফেরতের কোনো সম্ভাবনার খবর নেই।
গ্রাহকরা এখন একটাই প্রশ্ন করছেন—“আমাদের টাকাগুলোর কি হবে?” এই প্রশ্নের উত্তর এখন পুরো অনলাইন ট্রাভেল খাতের জন্য একটি পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ