
ছবি: সংগৃহীত
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সনদটি বাস্তবায়ন নিয়ে জোর বিতর্ক চলছে—কখন, কীভাবে এবং কোন আইনি প্রক্রিয়ায় এটি কার্যকর হবে, তা নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গণভোটের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা চালালেও দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি।
এই প্রেক্ষাপটে শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) দিনটি ঠিক করা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের জন্য। তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতপার্থক্য থাকায় এখানেও অনিশ্চয়তার মেঘ ঘন হচ্ছে। বিশেষ করে কোন দল সনদে সই করবে, কারা বিরত থাকবে, সে নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষ আইনজীবীরা বলছেন, সংবিধানেই সনদের আইনি ভিত্তি নিহিত—সংসদ ছাড়া কোনো সনদকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয়। তারা সতর্ক করছেন, সংবিধানিক প্রক্রিয়া পাশ কাটিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতাকে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন: ‘এটি জনগণের চুক্তি, বাস্তবায়নও জনগণ করবে’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, “ইংল্যান্ডের ম্যাগনা কার্টা বা সিটিজেন চার্টারের মতোই জুলাই সনদ জনগণের সামাজিক চুক্তি হতে পারে। সংসদ এখন নেই, নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই—তবু রাজনৈতিক দলগুলো মানবাধিকার, আইনের শাসন, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার নিশ্চয়তা দিয়ে একটি নৈতিক চুক্তি করতে পারে। শেষ পর্যন্ত জনগণই ভোটের মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে।”
তিনি আরও বলেন, “সংসদীয় গণতন্ত্রে একনায়কতন্ত্র চলতে পারে না। সব অবস্থায় রোল অব ল’ থাকতে হবে। আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে এবং যারা গুম-খুন বা মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত—তাদের বিচার হতে হবে।”
তবে তিনি এটিও স্বীকার করেন,“জুলাই সনদকে সংবিধানে যুক্ত করার প্রক্রিয়া আমার কাছে স্পষ্ট নয়।”
অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব: ‘সংসদ ছাড়া সংবিধানে হাত দেওয়া যায় না’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, “জুলাই সনদ জন্ম থেকেই সাংবিধানিকভাবে বাতিলযোগ্য। সংবিধান অনুযায়ী সংসদ ছাড়া কোনো অনুচ্ছেদ যুক্ত বা সংশোধন করা যায় না। রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতা থাকলেও সংসদ ও রাষ্ট্রপতি অনুপস্থিত থাকলে তা প্রযোজ্য নয়।”
তিনি আরও বলেন, “যদি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ না নিয়ে শহীদ মিনারে জনগণের নামে শপথ নিতো, তাহলে সংবিধান সাময়িক স্থগিত থেকে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা যেতো। কিন্তু এখনকার কাঠামোয় সেই আইনি পরিসর নেই।”
ব্যারিস্টার এম. আশরাফুল ইসলাম: ‘আইনগত বৈধতা পেতে সংসদে টু-থার্ড মেজরিটি প্রয়োজন’
ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম বলেন, “সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জুলাই সনদকে বিল আকারে পাস করলেই এটি আইনি বৈধতা পাবে। বিকল্পভাবে গণভোটের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া যেতে পারে। তবে এর বাইরে কোনো পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন আইনি ভিত্তিহীন হবে।”
তিনি সতর্ক করেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্ন মত থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু জনগণের অনুমোদন ছাড়া কোনো দল আইন প্রণয়ন করতে পারে না। আইন তৈরি হয় সংসদে—এটাই সংবিধানিক পথ।”
অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান: ‘জুলাই সনদ হলো বিপ্লবী স্পিরিটের দলিল’
অন্যদিকে অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান মনে করেন, “জুলাই সনদ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর চুক্তি নয়, এটি সারাদেশের ‘বিপ্লবী জুলাইযোদ্ধাদের’ আত্মিক দলিল। তবে এটি বাস্তবায়নের জন্য আইন প্রণয়ন অপরিহার্য। রাষ্ট্রপতি চাইলে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গেজেট নোটিফিকেশন করে সনদকে কার্যকর করতে পারেন।”
গণভোট নিয়ে তিনি বলেন, “পিআর পদ্ধতির ভোট নিয়ে গণভোট হতে পারে, কিন্তু জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট জরুরি নয়। এটি রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কার্যকর করা সম্ভব।”
বাস্তবায়নের কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব—সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার। সনদটি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত:
১️⃣ সনদের পটভূমি,
২️⃣ ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব, এবং
৩️⃣ বাস্তবায়নের সাত দফা অঙ্গীকারনামা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতোমধ্যে ৩০টি রাজনৈতিক দলের কাছে চূড়ান্ত অনুলিপি পাঠিয়েছে। শুক্রবার জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে সই অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
তবে দলগুলোর মধ্যে এখনো মতানৈক্য রয়ে গেছে—গণভোটের সময়, বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং সাংবিধানিক মর্যাদা নিয়ে। কেউ চাইছে নভেম্বরেই গণভোট, কেউ আবার সংসদ নির্বাচনের দিন একইসঙ্গে আলাদা ব্যালটে গণভোট আয়োজনের পক্ষে।
সারসংক্ষেপে আইনজীবীদের অভিমত
বিষয় | আইনজীবীদের মত |
---|---|
আইনি বৈধতা | সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা গণভোটে অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয় |
সংবিধান সংশোধন | অন্তর্বর্তী সরকার এককভাবে তা করতে পারবে না |
গণভোটের ভূমিকা | জুলাই সনদের অনুমোদনে নয়, নির্বাচনী পদ্ধতি নির্ধারণে প্রয়োজন হতে পারে |
জনগণের ভূমিকা | জনগণই চূড়ান্ত বাস্তবায়নকারী ও বৈধতার উৎস |
রাষ্ট্রপতির ভূমিকা | অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে গেজেট প্রকাশ করা যেতে পারে, তবে সীমিত পরিসরে |
জুলাই জাতীয় সনদ এখন দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও, এর বাস্তবায়নে সাংবিধানিক সীমারেখা ও রাজনৈতিক ঐকমত্যই চূড়ান্ত পরীক্ষার মুখে। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনো সনদই রাষ্ট্রীয় বৈধতা পেতে পারে না—তাই জুলাই সনদের টেকসই রূপ পেতে হলে রাজনৈতিক ঐক্যের পাশাপাশি সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুসরণই হবে একমাত্র পথ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ