
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক আগ্রহ আরও বেড়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক স্বাধীন ও অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) নির্বাচনী পরিবেশ ও প্রস্তুতি যাচাইয়ে ঢাকায় তাদের প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে।
সোমবার বিকেলে প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় এসে পৌঁছে প্রথমেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে। বৈঠকে অংশ নেন পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। দুই পক্ষের আলোচনায় আসন্ন নির্বাচনের সার্বিক পরিবেশ, প্রশাসনিক প্রস্তুতি, রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদারের উপায় নিয়ে মতবিনিময় হয়।
আইআরআই-এর দলটি শুধুমাত্র নির্বাচনী পর্যবেক্ষণই নয়, বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে মূল্যায়নের একটি বৃহৎ কাঠামোতেও কাজ করছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামি (যদি সাক্ষাতের অনুমতি থাকে) এবং নতুন উদীয়মান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করবেন।
আইআরআই জানায়, তাদের এই সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতিযোগিতা, নাগরিক সম্পৃক্ততা, রাজনৈতিক সমতা এবং প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা মূল্যায়ন করা।
সংস্থাটির মতে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে না—বরং ভোটারদের স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার পরিবেশ, নির্বাচনী প্রশাসনের স্বচ্ছতা, এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও এর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আইআরআইয়ের এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের সিনিয়র ডিরেক্টর জোহানা কাও এক বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের মিশন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পুনর্নিশ্চিত করে। আমরা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করতে এবং নির্বাচনী পরিবেশের বর্তমান অবস্থা মূল্যায়ন করতে আগ্রহী।”
তিনি আরও বলেন, আইআরআই বরাবরই মনে করে, গণতন্ত্র তখনই সফল হয় যখন ভোটাররা আস্থার সঙ্গে অংশ নিতে পারেন এবং প্রতিটি প্রার্থী ও দল সমান সুযোগ পান।
সূত্র জানায়, আইআরআই দলটি আগামী এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় অবস্থান করবে। এ সময় তারা নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র, আইন, ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করবে। এছাড়া তারা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করবে।
ঢাকার বাইরে নির্বাচনী কার্যক্রম মূল্যায়নের অংশ হিসেবে তারা চট্টগ্রাম ও রাজশাহী অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসন এবং রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনাও করেছে।
আইআরআইয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সফর শেষে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রশাসনিক কার্যকারিতা এবং নির্বাচনী অখণ্ডতা বজায় রাখার বিষয়ে একটি বিস্তৃত মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করবে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভাবনা সম্পর্কেও সুপারিশ থাকবে।
বাংলাদেশে আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আন্তর্জাতিক মহলে এখন তীব্র আগ্রহ দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ ইতোমধ্যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইআরআই দলটি এই ধারাবাহিকতার প্রথম আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদল হিসেবে বাংলাদেশে এসেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সফর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণে একটি “প্রাথমিক সূচক” হিসেবে কাজ করবে।
১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত আইআরআই বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী গণতন্ত্র ও সুশাসন বিষয়ক সংগঠন হিসেবে পরিচিত। সংস্থাটি গত চার দশকে ২৫০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ মিশন পরিচালনা করেছে।
লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া—সবখানেই আইআরআই বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে কাজ করেছে।
বাংলাদেশেও সংস্থাটির আগ্রহ নতুন নয়। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন, ২০০৮ সালের রাজনৈতিক সংস্কারকাল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আইআরআই অনানুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়েছিল। এবার তারা সরাসরি মাঠে নেমে নির্বাচনী পরিবেশ মূল্যায়ন করছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক নজরদারির সূচনা বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আইআরআই জানিয়েছে, মিশন শেষে তারা নির্বাচনী প্রস্তুতির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। প্রতিবেদনে থাকবে নির্বাচনের আগে পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখার উপায়, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা রক্ষা, প্রার্থী নিবন্ধন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, ভোটার তালিকার নির্ভুলতা, ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সুপারিশ।
আইআরআই বলছে, তাদের লক্ষ্য কোনো পক্ষ নেওয়া নয়; বরং এমন সুপারিশ প্রদান করা যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে আরও অংশগ্রহণমূলক ও গণতান্ত্রিক করে তুলবে।
বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “বাংলাদেশ সবসময় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক ও বন্ধুপ্রতিম সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। আমরা চাই নির্বাচন হোক অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ এবং শান্তিপূর্ণ। আইআরআইয়ের এই সফর সে প্রচেষ্টারই একটি ইতিবাচক অংশ।”
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন চ্যালেঞ্জের মুখে হলেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও নীতিগত সমর্থনের মাধ্যমে এটি আরও দৃঢ় ভিত্তি পেতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইআরআইয়ের এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নির্বাচনী গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সর্বোপরি, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই প্রতিনিধি দলের সফর বাংলাদেশের নির্বাচন প্রস্তুতি, রাজনৈতিক সংলাপ ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার এক নতুন অধ্যায় খুলে দিল—যা ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আরও গভীর করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ