ছবি: সংগৃহীত
দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তার মুখে। সম্প্রতি বন্দরের বিভিন্ন সেবায় গড়ে ৪১ শতাংশ পর্যন্ত ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে ক্ষোভে ফুঁসছে বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়িক মহল। তাঁরা সতর্ক করেছেন—যদি সরকার দ্রুত এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করে, তাহলে দেশের সবচেয়ে বড় বন্দর কার্যত অচল হয়ে পড়তে পারে। এতে শুধু বাণিজ্য নয়, পুরো অর্থনীতি স্থবির হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৯২ শতাংশই পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। দেশের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস ও বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে বন্দরটি বিগত বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে লাভজনক ছিল। সেই প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে এতো বড় অঙ্কে ট্যারিফ বৃদ্ধি ব্যবসায়ী সমাজের কাছে ‘অযৌক্তিক ও ধ্বংসাত্মক’ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
গত ১৯ অক্টোবর যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের কঠোর প্রতিবাদের মুখে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রবেশ গেট পাস ও সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারীদের গেট পাস ফির বর্ধিত অংশ স্থগিত করতে বাধ্য হয়। এর একদিন আগে, ১৮ অক্টোবর পোর্ট ইউজার্স ফোরামের এক বিশেষ সভায় ব্যবসায়ী নেতারা হুঁশিয়ারি দেন—সাত দিনের মধ্যে বর্ধিত ট্যারিফ প্রত্যাহার না করা হলে তাঁরা বন্দর বন্ধ করে দেবেন।
এখন সেই আলটিমেটামের চারদিন কেটে গেলেও সমাধানের কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। বরং ব্যবসায়ী মহলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, প্রশাসনিক জটিলতা ও অনমনীয় অবস্থানের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর শিগগিরই অচলাবস্থায় পড়তে পারে।
বিজিএমইএর পরিচালক ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, “বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে গড়ে ৪১ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কিছু ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধি ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত। আমরা কোনোভাবেই এই অযৌক্তিক ট্যারিফ মেনে নিতে পারি না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা ব্যবসায়ী—রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে পারি না, কিন্তু আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বন্দর কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করা। অন্যথায় আমদানি-রপ্তানিতে ভয়াবহ অচলাবস্থা তৈরি হবে।”
চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ শিল্প গ্রুপ সিকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, “ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর কোনো প্ল্যাটফর্ম না থাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো ট্যারিফ বাড়িয়েছে। এমনভাবে চাপিয়ে দেওয়া ট্যারিফ ব্যবসায়ীরা মানবে না।”
তিনি অভিযোগ করেন, “৩৯ বছর পর ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে—এই যুক্তি সঠিক নয়। ১৯৮৬ সালে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৩০ টাকা, এখন তা ১২২ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে ট্যারিফ কার্যত চারগুণ বেড়ে গেছে আগেই। এখন আবার ৪১ শতাংশ বাড়ানো মানে রপ্তানি খাত ও জাতীয় অর্থনীতিকে চাপে ফেলা।”
আমিরুল হক বলেন, “ট্যারিফ বাড়িয়ে বিদেশি অপারেটর আনার পরিকল্পনা যদি থাকে, তবে সেটা আরও বিপজ্জনক। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই যৌক্তিক হারে ট্যারিফ সমন্বয় করা উচিত।”
১৮ অক্টোবরের সভায় উপস্থিত ব্যবসায়ী নেতারা স্পষ্ট করে বলেছেন—“যদি কোনো কারণে চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে যায়, তার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।” তাঁরা মনে করছেন, সরকারের অযৌক্তিক ট্যারিফ অনুমোদনের ফলে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, খাদ্যপণ্যসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও আরও বেড়ে যাবে।
নতুন ট্যারিফ প্ল্যান অনুযায়ী, বন্দরের ৫৬টি সেবার বিপরীতে গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তা দ্বিগুণ থেকে চারগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়—পণ্যভর্তি প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে (টিইইউ) মাশুল ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, “বন্দর বলছে গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু শিপিং সেবার ক্ষেত্রে তা ৭০ শতাংশেরও বেশি। কিছু ক্ষেত্রে ফি বেড়েছে ৫০০ গুণ পর্যন্ত।”
তিনি উদাহরণ দেন, “আগে একটি জাহাজ বন্দরে প্রবেশে ব্যবহৃত টাগবোটের ভাড়া ছিল ২৬০০ ডলার। এখন তা বেড়ে ১৬ হাজার ডলারের বেশি হয়েছে।”
আরিফ বলেন, “শিপিং লাইনগুলোর সঙ্গে এজেন্টদের ছয় মাস থেকে এক বছরের চুক্তি থাকে। চুক্তি শেষে তারা বাড়তি ব্যয় পুষিয়ে নিতে চার্জ বাড়াবে। এতে জাহাজ ভাড়া বাড়বে, আর সেই খরচ শেষ পর্যন্ত আমদানিকারকদের পণ্যের দামে যুক্ত হবে। ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে, সাধারণ ভোক্তাই ভুক্তভোগী হবে।”
সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যবসায়িক করপোরেশন নয়। এটি ইতিমধ্যেই লাভজনক সংস্থা। প্রশ্ন হলো—কেন হঠাৎ এমন হারে ট্যারিফ বাড়ানো হলো? কেন বন্দরকে আরও লাভজনক দেখানোর নামে আমদানি-রপ্তানির ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে?”
তিনি উল্লেখ করেন, “ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় সবাই সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত ধাপে ধাপে ট্যারিফ সমন্বয়ের পক্ষে ছিল। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ একতরফাভাবে এই বিশাল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পুরো সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ডেকে আনবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর স্থবির হলে তা শুধু একটি অঞ্চলের সমস্যা নয়, পুরো দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প, আমদানি নির্ভর খাদ্য ও কাঁচামাল সরবরাহ চেইন, এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ—সবকিছুই বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ডলার সংকট ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির চাপের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে যদি বন্দর কার্যক্রমে বাধা পড়ে, তবে পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে, বৈদেশিক আয়ের উৎসগুলো হুমকিতে পড়বে।
বিজিএমইএ, শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন যৌথভাবে দাবি জানিয়েছে—বর্ধিত ট্যারিফ অবিলম্বে স্থগিত করে আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক হার নির্ধারণ করা হোক। তাঁরা চান, সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে চট্টগ্রাম বন্দরের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করুক।
সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বলেন, “এই সংকট শুধু বন্দরের নয়, দেশের সাধারণ মানুষেরও সংকট। সরকারের উচিত দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করা। বন্দর অচল হলে তার দায় কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন নয়—সরকারকেই নিতে হবে।”
চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনরেখা। এই বন্দরের ওপর নির্ভর করে দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান। অথচ এখন অযৌক্তিক ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণে সেই জীবনরেখা হুমকির মুখে। ব্যবসায়ী সমাজের সরব প্রতিবাদ, বন্দর কর্তৃপক্ষের নীরবতা এবং সরকারের দেরি—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।
সময় থাকতে যদি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না আসে, তবে “বর্ধিত ট্যারিফ” নামের এই সিদ্ধান্তই হয়তো দেশের অর্থনীতিকে এক অচল অন্ধকারে ঠেলে দেবে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



