
ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতি এখন এক জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, বিনিয়োগ স্থবিরতা, উচ্চ সুদের হার, এবং লাগামহীন মূল্যস্ফীতি—এই তিন বড় চ্যালেঞ্জের কারণে অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজস্ব ঘাটতি, আমদানি ব্যয়ের হ্রাস, রপ্তানির অনিশ্চয়তা, এবং আস্থাহীনতার এক গভীর সংকট।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সংকটের গভীরতা শুধু পরিসংখ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের জীবনযাত্রায়, কর্মসংস্থানে এবং ব্যবসার মূলে। সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে নানা সংস্কার উদ্যোগ নিলেও এখনো আশানুরূপ গতি ফিরে আসেনি।
অর্থনীতির মলিন চিত্র উঠে এসেছে সরকারি পর্যবেক্ষণেই
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) সম্প্রতি প্রকাশিত অক্টোবর মাসের ইকোনমিক আপডেট-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। ব্যাংকগুলো এখন ঋণ বিতরণে সতর্ক, ফলে উদ্যোক্তারা নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ নিতে নিরুৎসাহ হচ্ছেন।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংক খাতে উচ্চ সুদের হার, আমানতের কম মুনাফা, এবং খেলাপি ঋণের উচ্চমাত্রা আর্থিক খাতের আস্থা নষ্ট করছে। এর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি থমকে গেছে এবং উৎপাদন খাতে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এই পরিস্থিতি এক “নিম্ন প্রবৃদ্ধির ফাঁদে” রূপ নিচ্ছে—যেখানে বিনিয়োগ না বাড়লে প্রবৃদ্ধি স্থায়ীভাবে নিচের দিকে চলে যাবে।
বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নেমেছে দশকের সর্বনিম্ন স্তরে
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্ট শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৩৫ শতাংশে—গত ১০ বছরের মধ্যে এটি অন্যতম সর্বনিম্ন হার। অথচ গত এক দশকে এই প্রবৃদ্ধি সাধারণত ১২ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে ছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নিম্ন প্রবৃদ্ধি মানে হলো—উৎপাদন, শিল্পায়ন, রপ্তানি এবং কর্মসংস্থানের সব চাকা একসঙ্গে ধীর হয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে ব্যাংকগুলো এখন সরকারি ঋণ সরবরাহে বেশি আগ্রহী। সরকার উচ্চ সুদে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার নিচ্ছে, যা ব্যাংকের কাছে ঝুঁকিমুক্ত এবং লাভজনক। ফলে বেসরকারি খাতকে ঋণ দেওয়ার প্রবণতা কমছে।
অর্থনীতিবিদরা একে বলছেন “ক্রাউডিং আউট ইফেক্ট”—অর্থাৎ সরকারের ঋণগ্রহণের ফলে বেসরকারি খাতকে বাজার থেকে কার্যত ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এতে উদ্যোক্তারা ব্যাংকঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং বিনিয়োগ থেমে যাচ্ছে।
উচ্চ সুদের হার: বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন
বর্তমানে ব্যাংকঋণের গড় সুদের হার ১৩ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে ঘুরছে। তবে অনেক উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, গোপনে আরও বেশি সুদ নিতে হচ্ছে, যা প্রকৃত খরচকে দ্বিগুণ করে দিচ্ছে।
তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংক ঋণের এই উচ্চ হার তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে। বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “ব্যবসায়ীরা হিসাব করে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু যখন মাঝপথে ব্যাংক সুদের হার বেড়ে যায়, তখন কিস্তির পরিমাণ এমনভাবে বাড়ে যে মুনাফা আর থাকে না। এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই প্রধান চ্যালেঞ্জ, নতুন বিনিয়োগের কথা ভাবার সময় নেই।”
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উচ্চ সুদের হার শুধু ব্যবসায়িক গতি রুদ্ধ করছে না, বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনাকেও নিঃশেষ করছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এসএমই) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
মূল্যস্ফীতির চাপ: মধ্যবিত্তের আয় কমেছে, ব্যয় বেড়েছে
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরপর চার মাস ধরে সাধারণ মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ওপরে স্থির আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮.৩৬ শতাংশে।
খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা কমলেও মাছ, মাংস, ফলমূল, তেল ও বাড়িভাড়া বেড়েছে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখনো অস্বস্তিতে। চালের দাম কিছুটা কমলেও বাজারের সার্বিক ব্যয় কমছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে স্থির থাকা মানে “বাস্তবে তা কমছে না, বরং মানুষের আয়-ব্যয়ের ব্যবধান আরও বাড়ছে।”
একজন বেসরকারি কর্মকর্তা বলেন, “আগে মাসের শেষের দিকে টান পড়ত, এখন বেতন পাওয়ার পরদিনই হিসাব মেলাতে কষ্ট হয়।”
রপ্তানি ও রেমিট্যান্স: স্বস্তির মধ্যেও অনিশ্চয়তা
রপ্তানি আয় অর্থনীতিকে কিছুটা টিকিয়ে রেখেছে, তবে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এর প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তৈরি পোশাক খাতে ইউরোপীয় বাজারে অর্ডার কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয় ধীর হয়েছে।
তবে ইতিবাচক দিক হলো—বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩১ বিলিয়ন ডলারের ওপরে, যা গত কয়েক মাসে কিছুটা স্থিতিশীলতা এনেছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহও বেড়েছে, যা এখন অর্থনীতির অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভ। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের পাঠানো টাকাই মূলত দেশে ভোগব্যয় ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখছে।
রাজস্ব আয় বাড়লেও ঘাটতি রয়ে গেছে
সরকারি রাজস্ব আয় প্রবৃদ্ধিতে উন্নতি হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২১ শতাংশ। এর মধ্যে ভ্যাট আদায় বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, আয়কর ২৪ শতাংশ। তবে আমদানি কমে যাওয়ায় শুল্ক আদায় কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি হ্রাস মানে শিল্প খাতে কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়া—যা ভবিষ্যতের উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকার এখন রাজস্ব প্রশাসন শক্তিশালী করতে নতুন কমিশনারেট ও পদ সৃষ্টি করছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে রাজস্ব আদায় বাড়তে পারে, তবে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো স্বস্তি মিলবে না।
বিনিয়োগে গতি ফেরাতে দরকার আস্থা ও স্থিতিশীলতা
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শুধুমাত্র সুদের হার কমানোই যথেষ্ট নয়। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে—যেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি সহায়তা ও স্বচ্ছতা থাকবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমানে ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে এক ধরনের “নীতিগত অনিশ্চয়তা” কাজ করছে। কেউ জানেন না আগামী ছয় মাস বা এক বছর পর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে। এই ভয় দূর না হলে বিনিয়োগ ফিরবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনীতি একেবারে খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু এখনো স্থিতিশীল হয়নি। বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও বাড়বে না, আর প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না।”
সিপিডির বিশ্লেষণ: রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতাই মূল প্রতিবন্ধকতা
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, “গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা ও আস্থার ঘাটতি নতুন বিনিয়োগে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল, তবুও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখনো অপেক্ষা করছেন। বাস্তব পরিবর্তনের জন্য সরকারকে সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।”
সামনে পথ: অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ
অর্থনীতিবিদদের সার্বিক মত, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন “সতর্ক ভারসাম্যে” আছে। রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছে, রাজস্ব আদায় উন্নতি করছে, এবং মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল হচ্ছে। কিন্তু যদি বিনিয়োগের গতি না বাড়ে, তবে এই ভারসাম্য ভঙ্গ হতে সময় লাগবে না।
তিন প্রধান চ্যালেঞ্জ—বিনিয়োগ স্থবিরতা, উচ্চ সুদের হার এবং মূল্যস্ফীতি—সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে, এবং অর্থনীতির গতি থেমে যাবে।
অর্থনীতিবিদরা জোর দিয়ে বলছেন, “এখন সময় একমুখী পদক্ষেপের—আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, বিনিয়োগে গতি আনতে হবে, আর ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবেই অর্থনীতি আবার প্রাণ ফিরে পাবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ