
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রক সংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি মাহফুজ আনাম জেমস আবারও আলোচনায়—তবে এবার তার কোনো নতুন গান বা কনসার্ট নয়, ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দঘন একটি খবর নিয়ে। তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেছেন তিনি, আর এই নতুন দাম্পত্যে সম্প্রতি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন তার স্ত্রী নামিয়া আমিন।
রকস্টার জেমস, যিনি ‘গুরু’ নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত, জানালেন—গত বছরের মাঝামাঝি সময়েই তিনি বিয়ে করেছিলেন নামিয়াকে। নামিয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক, পেশায় শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবায় যুক্ত। ২০২৫ সালের ৮ জুন নিউইয়র্কের হান্টিংটন হাসপাতালে ভোর সাড়ে তিনটায় তাদের প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। নবজাতকের নাম রাখা হয়েছে জিবরান আনাম।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জেমস বলেন, “এই অনুভূতি বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, তিনি আমাকে আবারও পিতা হওয়ার সৌভাগ্য দিয়েছেন। আমার সন্তান ও স্ত্রীর জন্য সবাই দোয়া করবেন।”
এই কথাগুলোতে ফুটে ওঠে এক প্রখ্যাত শিল্পীর জীবনের গভীরতম মানবিক সুখ—যে মানুষ হাজারো কনসার্টে লাখো দর্শককে মাতিয়েছেন, সেই তিনিই এখন নিজের ছোট পরিবারকে ঘিরে আবেগে আপ্লুত।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সন্তান জন্মের সময় জেমস নিজে উপস্থিত ছিলেন। হাসপাতালে স্ত্রী ও নবজাতকের পাশে থেকে তিনি পুরো প্রক্রিয়াটিই কাছ থেকে দেখেছেন। এরপর এক মাস যুক্তরাষ্ট্রে থেকে তারা জুনের শেষ দিকে দেশে ফেরেন। বর্তমানে জেমস পরিবারসহ ঢাকায় নিজ বাসায় অবস্থান করছেন।
জেমস ও নামিয়ার প্রথম পরিচয় ২০২৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রে। ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের দেখা হয়। নামিয়া তখন অনুষ্ঠান আয়োজনে যুক্ত ছিলেন, আর জেমস ছিলেন বিশেষ অতিথি শিল্পী হিসেবে। প্রথম সাক্ষাৎেই দুজনের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হয়, পরে নিয়মিত কথাবার্তার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে।
এক বছরের মধ্যেই তাদের সম্পর্ক পরিণতি পায় বিবাহে। ২০২৪ সালের ১২ জুন ঢাকায় পারিবারিক আয়োজনের মাধ্যমে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। দুই পরিবারের অল্প কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও বন্ধু উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। বিয়ের খবরটি দীর্ঘ সময় গণমাধ্যমের অগোচরেই ছিল; এমনকি ভক্তরাও বিষয়টি জানতে পারেননি, কারণ জেমস ব্যক্তিজীবন নিয়ে কখনো প্রচারে আসেন না।
জেমসের স্ত্রী নামিয়া আমিনের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে। বাবা-মা বাংলাদেশি হলেও তিনি বড় হয়েছেন নিউইয়র্কে। শিক্ষা জীবন শেষ করেছেন জন জে কলেজ অফ ক্রিমিনাল জাস্টিস থেকে। সমাজবিজ্ঞান ও অপরাধমনস্তত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ননপ্রফিট সংস্থায় কাজ করছেন, যেখানে অভিবাসী নারী ও শিশুদের সহায়তা প্রদান করা হয়।
নামিয়া শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতিও আগ্রহী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সংগীত ও থিয়েটার ক্লাবে সক্রিয় ছিলেন, এমনকি কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রেও কাজ করেছেন। বন্ধুদের ভাষায় তিনি “সাহসী, বিনয়ী ও বুদ্ধিদীপ্ত”—যা হয়তো জেমসকেও মুগ্ধ করেছে।
এই বিয়ের মাধ্যমে এটি জেমসের তৃতীয় দাম্পত্য জীবন। তার প্রথম বিয়ে হয় ১৯৯১ সালে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রথির সঙ্গে। রথির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে ২০০৩ সালে। সেই সংসারে জেমসের একটি পুত্র ও একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
পরবর্তীতে ২০০০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে পরিচয় হয় বেনজীর সাজ্জাদ নামে এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারীর সঙ্গে। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং বিয়ে হয় আমেরিকাতেই। তবে এই সম্পর্কও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; ২০১৪ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। দ্বিতীয় সংসারে জেমসের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে, যিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন।
বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে জেমস শুধু একজন শিল্পী নন, এক জীবন্ত কিংবদন্তি। “নগর বাউল”, “দুখিনী দুখিনী”, “গুরু”, “বেদনার বৃষ্টি”, “সুলতানা বিবিয়ানা”, “জ্বালা জ্বালো” থেকে শুরু করে বলিউডের জনপ্রিয় গান “ভিগি ভিগি”, “ভিক্রাম ভেত্তি”, “আলবিদা” পর্যন্ত—প্রতিটি গানে জেমস নিজেকে প্রমাণ করেছেন এক অনন্য শিল্পী হিসেবে।
তবে ব্যক্তিজীবন নিয়ে তিনি সবসময়ই নীরব ছিলেন। গণমাধ্যমে খুব কমই নিজের পারিবারিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেছেন। নতুন বিয়ে ও সন্তান জন্মের খবরটিও দীর্ঘদিন গোপন ছিল, যতদিন না কাছের সূত্র থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে।
তার ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী জানান, “জেমস ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে খুবই সংযত। তিনি চান না, পরিবারকে ঘিরে কোনো প্রচার বা বিতর্ক তৈরি হোক। এখন তিনি পরিবারকে সময় দিচ্ছেন, নতুন গান ও প্রজেক্টের কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছেন।”
নিউইয়র্কের হান্টিংটন হাসপাতালের ডেলিভারি রুমে যখন জিবরান আনাম জন্ম নেন, তখন জেমস নিজ হাতে সন্তানকে কোলে নেন। উপস্থিত চিকিৎসকেরা বলেন, নবজাতক সম্পূর্ণ সুস্থ। জন্মের সময় তার ওজন ছিল ৩ কেজি ১২০ গ্রাম।
পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, জেমস নিজের হাতে ছেলেকে প্রথম গোসল করান এবং নাম রাখেন “জিবরান আনাম”—যার অর্থ “শক্তি ও জ্ঞান”। নামটি রাখা হয়েছে জেমসের প্রিয় লেবানিজ দার্শনিক ও কবি খলিল জিবরান-এর নামানুসারে।
বর্তমানে জেমস নিজের নতুন সংসারকে কেন্দ্র করে পুরোপুরি পারিবারিক জীবনে মনোযোগী। তার ঘনিষ্ঠদের মতে, তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি শান্ত ও সংযত জীবনযাপন করছেন। প্রতিদিন সকালে সন্তানকে সময় দেন, স্ত্রীর সঙ্গে একসঙ্গে নামাজ আদায় করেন, এমনকি রান্নাঘরেও সাহায্য করেন—যা তার আগের জীবনে কল্পনাতীত ছিল।
এক সাক্ষাৎকারে জেমস হেসে বলেন, “এই সন্তান আমার জীবনকে বদলে দিয়েছে। আগে আমি শুধু গান নিয়েই বাঁচতাম, এখন আমি পরিবারের হাসিতে বাঁচি।”
নতুন পরিবার ও সন্তানকে সময় দিতে সাময়িক বিরতি নিয়েছেন জেমস। তবে সংগীত থেকে দূরে নন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময়ই কয়েকটি নতুন গান রেকর্ড করেছেন বলে জানা গেছে। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, “জেমস শিগগিরই ‘নগর বাউল’-এর নতুন অ্যালবামের কাজে ফিরবেন।”
ভক্তরা ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। কেউ লিখেছেন—“গুরু আবার গুরু হয়ে ফিরেছেন, এবার পিতা হিসেবে।”
বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসে জেমস এক অনন্য নাম। তবে তার জীবনের নতুন অধ্যায় প্রমাণ করছে—তার যাত্রা কেবল মঞ্চের আলোয় নয়, ব্যক্তিজীবনের গভীর ভালোবাসার মধ্যেও অব্যাহত।
একজন রকস্টার, তিনবারের বর, তিন সন্তানের পিতা—এখন তিনি কেবল শিল্পী জেমস নন, এক পূর্ণাঙ্গ মানুষ মাহফুজ আনাম জেমস।
ভক্তদের কাছে তার এই বার্তা— “সঙ্গীত আমার আত্মা, কিন্তু পরিবার আমার প্রাণ। দুটোই আমার জীবনের অংশ। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ